কবি তখন খুব ব্যস্ত। নিয়মিত গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে আসেন, গান লেখেন, সুর করেন, গান শিখিয়ে দেন। বেশির ভাগ গান গাইছেন কে মল্লিক। একদিন এই কে মল্লিকের কাছে এক লোক এলেন। লোকটির নাম প্রফেসর জি দাস। এসে ধরলেন মল্লিককে, সে গান গাইতে চায়। গান গাইতে হলে তো পরীক্ষা দিতে হবে কোম্পানিতে, পরীক্ষা নেওয়া হলো।
ফলাফল, একেবারে অচল! গান নেওয়া হবে না শুনে ওখানেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বেচারা প্রফেসর। কে মল্লিক যতই শান্তনা দেন, বেচারা ততই কাঁদেন। আওয়াজ শুনে এলেন কোম্পানির বড়বাবু। তিনি সব শুনে প্রফেসরকে বললেন, ‘আপনার গলা এখনো ঠিক হয়নি। সুর-তাল-লয় ঠিক থাকছেনা, কদিন পর আসুন, দেখা যাক কী হয়।’
প্রফেসর লোকটি তখন বড়বাবুর কাছে কয়েকজনের নামে বিচার দিলেন যারা তাকে ফুঁসলিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। ওরা নাকি তাকে এও বলেছে যে তোমার গলা ভালো হলেও কে মল্লিক হিংসা করে তোমাকে গান গাইতে দিবে না। বড়বাবু বুঝলেন যে বেচারা খুব সরল মানুষ, তাকে যেভাবে বুঝানো হয়েছে সে বুঝেছে। প্রফেসরের কান্না আর থামছে না।
এমন সময় রুমে ঢুকলেন কাজী নজরুল। কী ব্যাপার? বলে তিনি মনোযোগী হলেন কান্নাকাটির কারণ জানতে। বড়বাবু আর কে মল্লিক তাকে সব খুলে বললেন। কবি তখন বললেন, বেচারা থেকে রেকর্ডের আশ্বাস দিয়ে যখন মিষ্টি খাওয়া হয়েছে, অতএব তার একটা গান রেকর্ড করতেই হবে।
কে মল্লিক বললেন, ‘আরে কাজীদা, কী বলছেন আপনি? দেখছেন না লোকটা একজন পাগল।’
কবি উত্তর দিলেন, ‘আরে মল্লিক, আমরা বাঙালিরাও কিন্তু কম হুজুগে নই, দেশটাও হুজুগে।’ এই বলে কবি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোনো, তুমি কাল এসো, তোমাকে শিখিয়ে আমি রেকর্ড করিয়ে নেব।’ কবি নজরুল বলে কথা। মল্লিক আর বড়বাবু তাকে ভালো করেই জানেন। কাজেই সবাই পরবর্তী কান্ড তামাশা দেখার অপেক্ষায় থাকলেন।
কবি গান রেকর্ডের সব ব্যবস্থা করলেন। গান লেখা হলো, কবি প্রফেসরকে বললেন যে এই গানের কথা যেন কেউ জানতে না পারে, যখন গান বাজারে আসবে তখনই শোনা যাবে প্রথম। রেকর্ডের সব ঠিকঠাক করে কবি বললেন, 'আচ্ছা, এবার গান ধরো--কলা গাড়ি যায় ভষড় ভষড়/ ছ্যাকরা গাড়ি যায় খচাং খচ/ ইচিং বিচিং জামাই চিচিং/ কুলকুচি দেয় করে ফচ...’
অদ্ভুত এমন গান শুনে উপস্থিত বাকি দুজন ওখানেই হাসতে লাগলেন, কবির কান্ড দেখে তারা ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলছেন। পরের দিন এর আরেক জোড়া লিখে আনলেন কবি, এবার অপর পিঠে রেকর্ড করালেন--মরি হায় হায় হায়, কুব্জার কী রুপের বাহার দেখো।/ তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙা/ উপুড় করলে হয় সাঁকো।/ হরি ঘোষের চার নম্বর খুঁটো, মরি হায় হায় হায়...
এ গানে প্রফেসরকে যে চতুষ্পদ বানানো হচ্ছে, তাও কেউ টের পেল না। খুব উৎসাহে প্রফেসর রিহার্সাল করতে লাগলেন। রেকর্ডিং ম্যানেজারকেও জানানো হলো না, কী গান কাকে দিয়ে রেকর্ড হচ্ছে। চরম গোপনে গান দুটো রেকর্ড হলপ, তারপর বাজারে ছাড়া হলো।
বাজারে প্রকাশিত হওয়ার দু একদিন পর কবি মল্লিককে ডেকে বললেন, একটু দেখে আসুন তো বাজার থেকে, কেমন বিক্রি হচ্ছে গান দুটো?
বাজারে খোঁজ নিয়ে এসে মল্লিক হাসতে হাসতে বললেন কবিকে, ‘কাজীদা, খুব বিক্রি হচ্ছে অদ্ভুত গানদুটো। ক্রেতারা কিনছে আর গাইছে, কলা গাড়ি যায় ভষড় ভষড়...’
কোম্পানির ম্যানেজার তো দারুণ খুশি। বড়বাবুকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তো বলেছিলে, লোকটি পাগল। ওর গান তো বেশ সেল হচ্ছে, আরও দু একটা নাও না ওর গলায়...’
মল্লিক সাহেব দৌড়ে গিয়ে কাজীকে কর্তার প্রস্তাব জানালেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, মল্লিক সাহেব, এবার কিন্তু গালাগাল খেতে হবে, হুজুগে দেশে এসব একবারই চলে। বলেই আবার জোরে হাসিতে ফেটে পড়লেন কাজী নজরুল ইসলাম।
লেখা: সংগৃহীতছবি: সংগৃহীত
প্রিয় পাঠক, আপনিও অংশ নিতে পারেন আমাদের এ আয়োজনে। আপনার মজার (রম্য) গল্পটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়। লেখা মনোনীত হলেই যে কোনো শুক্রবার প্রকাশিত হবে।
কেএসকে/জেআইএম