আবু তালহা তোফায়েল
পৃথিবী জুড়ে মানুষের ঘরে ঘরে প্রতিদিন নব সৌরভ আর নতুন দিনের বার্তা নিয়ে নতুনের দূত হাজির হয়, আগমন ঘটে নবজাতকের। তাদের পরিচিতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- তার ‘নাম’। নাম ছাড়া কোন ব্যক্তি বা বস্তুর পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। তাই মানব সমাজে সন্তান জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তার একটি উত্তম নাম রাখা সার্বজনীন রীতি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সন্তানের সুন্দর নাম রাখা ও তার উত্তম তরবিয়তের ব্যবস্থা করা বাবার ওপর সন্তানের হক।’ (মুসনাদে বাজজার ৮৫৪০)
খারাপ বা কুৎসিত নাম রাখলে পরিবর্তন করা
নাম শুধু দুনিয়ার পরিচিতির জন্য নয়, বরং মৃত্যুর পরেও মানুষের নাম বেঁচে থাকে। হাদিসে পাকে এসেছে, ‘হাশরের ময়দানে প্রত্যেককে তার নামেই ডাকা হবে।’ (আবু দাউদ ২/৬৭৬)
আর সুন্দর এবং মন্দ নামের প্রভাব ব্যক্তির চরিত্রেও পড়ে। তাই কুৎসিত অর্থবোধক এবং আপত্তিকর নাম রেখে থাকলে তা পরিবর্তন করে নিতে হবে। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন্দ ও অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিতেন।’ (তিরমিজি ২৮৩৯)
ঈমানি ভালোবাসা এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দাবি হলো একজন অপরজনের নাম সম্পর্ক অবগত হওয়া। তাই এমন নাম রাখা উচিত নয়, যা বলতে মানুষ লজ্জাবোধ করে।
নবিগণ ও নেককার বুযুর্গদের নামে নাম রাখা
বড়দের নামে নাম রাখার ক্ষেত্রে এ রীতিটিও অনেক প্রাচীন। হাদিসের কিতাবে এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের মায়ের নাম ছিল মারইয়াম। তাঁর জন্মের কাহিনি পবিত্র কোরআনে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যখন নিজের কুদরতের প্রকাশ ঘটিয়ে কোনো পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়াই হজরত মারইয়ামের গর্ভ থেকে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিলেন, তার গোত্রের লোকেরা তাকে বলেছিল-
یٰۤاُخۡتَ هٰرُوۡنَ مَا کَانَ اَبُوۡکِ امۡرَ اَ سَوۡءٍ وَّ مَا کَانَتۡ اُمُّکِ بَغِیًّا
‘হে হারুনের বোন! তোমার বাবা তো মন্দ মানুষ ছিলেন না, তোমার মাও অসৎ চরিত্রের কোনো নারী ছিলেন না।’ (সুরা মারইয়াম: আয়াত ২৮)
আবার নবি হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ভাইয়ের নামও ছিল হারুন। তিনিও ছিলেন নবি! অথচ মুসা আলাইহিস সালাম ছিলেন হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের চেয়ে অনেক আগের। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সময়ের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও পবিত্র কোরআনে এভাবে মারইয়ামকে হারুনের বোন বলে উল্লেখ করা হল কেন?
সাহাবি হজরত মুগীরা ইবনে শোবা রাদিয়াল্লাহু আনহু খ্রিস্টানদের এলাকা নাজরানে গিয়েছিলেন। নাজরানবাসী তখন তাকে এ প্রশ্ন করে, তোমরা তো পড়- হে হারুনের বোন!, অথচ মুসা ও ঈসার মধ্যে কী দুস্তর ব্যবধান! এরপর তিনি মদীনায় ফিরে এসে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্নটি করেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ‘তারা তাদের নবিদের নামে ও তাদের পূর্বসূরি নেককার লোকদের নামে নামকরণ করতো।’ (মুসলিম ২১৩৫)
আমরা উপরে নবিদের নামে নামকরণের বিষয়টি উল্লেখ করেছি। পূর্বসূরি নেককার ব্যক্তিদের তালিকায় প্রথমেই তো নবিগণ, এরপর তাঁদের অনুসারী সাহাবিগণ, এরপর উম্মাহর পরবর্তীকালের বুযুর্গ ব্যক্তিগণ। নবিদের পর সাহাবিগণ শ্রেষ্ঠ মানব কাফেলা। তাদের সবাইকে নিয়েই পবিত্র কোরআনের ঘোষণা- ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।’
তারা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র মুখে তাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে। সেসব নাম ধরে তিনি তাদের ডেকেছেন; একটি নাম বরকতময় হওয়ার জন্য আর কী চাই!
সুন্দর ও অর্থবোধক নাম রাখা
নবজাতকের সুন্দর ও অর্থবহ নাম আবশ্যক। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুরুত্বারোপ করেছেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সুন্দর ও অর্থবোধক নাম রাখা মা-বাবা ও অভিভাবকের ওপর অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নামের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং তার প্রিয় বান্দাদের নামে নামকরণ করা উত্তম।
নাম পরিচয়ের মাধ্যম
মানুষের পরিচয়ের মাধ্যম হচ্ছে নাম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল, বর্তমান মুসলিম সমাজ ইসলামের দৃষ্টিতে নাম রাখার এ মহান গুরুত্ব পরিহার করে দিন দিন উদাসীনতার দিকে ছুটছে। ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধদের নামে মুসলমানগণ নিজেদের সন্তান-সন্ততির নামকরণ করছে। নাম শুনে বুঝা যায় না, মানুষটি মুসলিম কিনা।
আবার অনেক সময় দেখা যায়, মূল নাম আরবি ও অত্যন্ত সুন্দর হলেও মা-বাবা তথা অভিভাবকগণ ডাক নাম এমন শব্দের রেখেছেন, যা অনেক ক্ষেত্রে অর্থহীন এবং বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণের প্রমাণ করছে। যেমন- জর্জ, মাইকেল, জ্যাকার, নান্টু, রঞ্জন, শশী ইত্যাদি।
নামকরণে আল্লাহর নির্দেশ
নাম রাখার গুরুত্ব সম্পর্কেও ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে জাকারিয়া! আমি (আল্লাহ) তোমাকে একপুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ‘ইয়াহইয়া’। এই নামে এর আগে আমি কারও নামকরণ করিনি।’ (সুরা মারিয়াম: আয়াত ৭)
সুতরাং একটি সুন্দর নামে ভূষিত হওয়া প্রতিটি শিশুরই জন্মগত অধিকার। সন্তানের সুন্দর নাম রাখা মা-বাবার ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। বিশ্লেষণমূলক এ লেখা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম নবজাত শিশুদের নামের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রদান করেছে। কিন্তু অনেক মুসলিম তাদের সন্তানের নামকরণের ক্ষেত্রে সে নীতিমালা গ্রহণ করে না। সন্তানের নামকরণের ক্ষেত্রে তাই আরও জনসচেতনতা প্রয়োজন।
লেখক: তরুণ আলেম, সাংবাদিক ও সংগঠক।
এমএমএস/জিকেএস