দেশজুড়ে

তনুর ময়নাতদন্ত নিয়ে সিআইডি-ফরেনসিক বিভাগের টানাপোড়েন

কুমিল্লায় কলেজছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মরদেহের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। গত ৪ এপ্রিল কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে দেয়া প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে তনুকে হত্যা এবং ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। এর আগে মামলার ২য় তদন্ত সংস্থা ডিবি ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য ৩০ মার্চ জেলার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের কবর থেকে তনুর মরদেহ তুলে ২য় দফায় ময়নাতদন্ত এবং ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে। ২য় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় এরই মধ্যে কেটেছে ৪৬ দিন। একটি স্পষ্ট হত্যাকাণ্ডের আলামত খুঁজে পেতে কুমেকের ফরেনসিক বিভাগের যখন রহস্যজনক কারণে গলদঘর্ম অবস্থা ঠিক তখনই ময়নাতদন্তকারী মেডিকেল বোর্ডকে সিআইডি থেকে ডিএনএ নমুনা দেয়া হবে না মর্মে জানিয়ে দেয়া হয়। এরপর শনিবার কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) তনুর মরদেহের ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ডা. কামদা প্রাসাদ সাহার নেতৃত্বে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিআইডি থেকে ডিএনএ প্রতিবেদন সরবরাহ না করলেও শিগগিরই ২য় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ডা.কামদা প্রসাদ। ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে সিআইডির সঙ্গে কুমেকের ফরেনসিক বিভাগের টানাপোড়েন চলছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, গত ২০ মার্চ সোহাগী জাহান তনুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে কুমিল্লা সেনানিবাসের পাওয়ার হাউজ এলাকার পাশের একটি জঙ্গলে মরদেহ ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। পুলিশ, ডিবির পর বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। গত ২৮ মার্চ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য তনুর মরদেহের দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। আদালত কবর থেকে তনুর মরদেহ উত্তোলন করে পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য আদেশ দেন। গত ৩০ মার্চ তনুর মরদেহের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত করা হয়। ২য় ময়নাতদন্ত করার ৪৫ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো রহস্যজনক কারণে প্রতিবেদন দেয়া হয়নি। এর আগে প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন নিয়ে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন ‘ শরীরে এতো আঘাত থাকার পরও ডাক্তাররা কেন তনুর হত্যার আলামত খুঁজে পায় না।’ কুমেকের ফরেনসিক বিভাগ তনুর কাপড়, দাঁত ও নখের ডিএনএ ও ফিঙ্গার প্রিন্টের প্রতিবেদন চাইলে সিআইডি থেকে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলা হয়েছে ‘ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের নির্দেশে ডিএনএ ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করে প্রতিবেদন নিয়েছেন। এ প্রতিবেদন ময়নাতদন্ত কর্মকর্তা নিতে চাইলে আদালতের মাধ্যমে নিতে হবে।’ তবে এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে বছরে কয়েকশ’ হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে ডিএনএ প্রতিবেদন ছাড়াই। একটি মৃত্যুর কারণ বের করতে দেশে প্রচলিত যে ধরনের পরীক্ষা চালু রয়েছে, তনুর মরদেহের জন্য সব পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করা হয়েছে, এরই মধ্যে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক দলের হাতে সব প্রতিবেদনই এসেছে, তাহলে এ প্রতিবেদন দিতে এখন তারা (ডাক্তাররা) ডিএনএ প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করতে চাচ্ছে কেন ?’ সিআইডির ওই সূত্র আরও জানায়, ‘মামলা তদন্ত সংস্থা ডিএনএ’র জন্য কবর থেকে মরদেহ তুলেছিল, তাই আদালতের অনুমতি ছাড়া ফরেনসিক বিভাগের নিকট ডিএনএ প্রতিবেদন দেয়া হবে না।’ এদিকে, শনিবারের বৈঠকে শিগগিরই ২য় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বোর্ডের তিন সদস্যই একমত পোষণ করেছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কুমেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. প্রাসাদ জানান, ‘আমার দফতরে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা সভা হয়েছে, ওই সভায় সব বিষয় নিয়ে বোর্ডের সদস্যরা আলোচনা করেছেন, প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করেছি। এখন পর্যন্ত ডিএনএ প্রতিবেদন আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি, ডিএনএ প্রতিবেদন না পেলেও আমরা প্রতিবেদন দেয়ার জন্য একমত হয়েছি।’ ডিএনও প্রতিবেদন সিআইডি আদালতের অনুমতি ছাড়া দেবে না এমন সিদ্ধান্তের পর আপনারা আদালতের অনুমতি চাইবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে কেপি সাহা বলেন, ‘আমরা আবারও সিআইডির কাছে ডিএনএ প্রতিবেদন চাইবো।’ ওই বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান করুণা রানী কর্মকার ও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক মো. ওমর ফারুক উপস্থিত ছিলেন। সতর্ক গতিতে অগ্রসর হচ্ছে সিআইডিতনু হত্যাকাণ্ডের সকল তথ্য প্রমাণ এরই মধ্যে সিআইডির নিকট স্পষ্ট হলেও হত্যাকাণ্ডের স্থানটি একটি স্পর্শকাতর এলাকায় হওয়ার কারণে খুব সতর্ক গতিতে অগ্রসর হচ্ছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। মামলার তদন্ত সহায়ক দলের প্রধান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুৃল কাহহার আকন্দের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত সহায়ক দল মামলার তদন্ত অনেকটা শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কুমিল্লা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ড. নাজমুল করিম খান জানান, ‘আমাদের তদন্ত অনেকটা শেষ পর্যায়ে, কিছু দিনের মধ্যে কুমিল্লা সেনানিবাসের আরও সামরিক সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। তবে ২য় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যতো তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে, মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে তা আরও অনেক সহায়ক হবে।’কি আছে ২য় ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ রিপোর্টেতনুর নখ, চুল, কাপড়সহ শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে নেয়া ডিএনএ নমনুা এবং সন্দেভোজনদের ফিঙ্গার প্রিন্টের ডিএনও বিন্যাসের ফলাফল এরই মধ্যে তদন্ত সংস্থা সিআইডির হাতে এসেছে বলে জানা গেছে। যদিও সিআইডি থেকে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলেনি। এদিকে কুমেকের একটি সূত্র জানায়, তনুর প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার আগে মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে দেশে প্রচলিত যে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় ২য় ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রেও আঘাত, শ্বাসরোধ, বিষ প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট সকল পরীক্ষার পাশপাশি অতিরিক্ত তার প্যাগনেনসি পরীক্ষা করা হয়। তাই একদিকে যদি ডিএনএ প্রতিবেদনে ঘাতকদের ফিঙ্গার  প্রিন্টের আলামত থাকে এবং অপরদিকে প্রথম ও ২য় দফার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন একই কিংবা ভিন্ন হলে প্রথম ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. শারমীন সুলতানা এবং ২য় ময়নাতদন্তকারী বোর্ড বিতর্কের মুখে পড়তে চাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ফরেনসিক বিভাগ সংকট থেকে বাঁচতে ডিএনএ প্রতিবেদনের সহায়তা নিতে চাচ্ছে। কামাল উদ্দিন/এসএস/এমএস