জাতীয়

বিচার তাৎক্ষণিকভাবে করতে গেলে অবিচার হয়ে যায়

সব হত্যাকাণ্ড ও গুম-খুনের বিচার হবে জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিচার তাৎক্ষণিকভাবে করতে গেলে অবিচার হয়ে যায়। বিচারের মূল জিনিসটা হলো এটা সুবিচার হতে হবে...অবিচার যেন না হয়।

Advertisement

আজ সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ২১ জনের পরিবার ও সাতজন আহতের মধ্যে আর্থিক চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ২১ জনের শহীদ পরিবার ও সাতজন আহতের মধ্যে আর্থিক চেক হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আরও পড়ুন আহত ও শহীদ পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জুলাই শহীদ পরিবারের সাক্ষাৎ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতরা যেসব সুবিধা পাবেন

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই এই সংগ্রাম হয়েছে, এই আত্মত্যাগ হয়েছে। আমরা যদি অবিচারে নামি তাহলে তাদের আর আমাদের মধ্যে তফাৎটা থাকলো কোথায়। আমরা অবিচারে নামবো না। অপরাধীদের পুলিশের হাতে, আইনের হাতে সোপর্দ করবো। যারা অপরাধী নয়, পুলিশের হাতে দেওয়ার মতো নাই তাদের মানুষ করবো। ভাই, এদেশ আমরা একসঙ্গে গড়ি, যে দেশ আমরা একসঙ্গে গড়ার স্বপ্ন দেখছি, তোমরাও সে স্বপ্ন দেখো। এদেশ আমার একার নয়, তোমারও এদেশ। তুমি এদেশের সন্তান। আমিও এদেশের সন্তান। তুমি আমাকে বহু কষ্ট দিয়েছ। আমি তোমারে কষ্ট দেবো না। আমরা একযোগে যত তাড়াতাড়ি পারি এটাকে একটা সুন্দর দেশ বানাবো... যারা অপরাধী তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। যারা অপরাধী নয় তাদের সৎপথে নিয়ে আসতে হবে।

Advertisement

তিনি জুলাইয়ের শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের দেশে কোনো সহিংসতা ও হানাহানি যেন না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সবসময় ভাবি যাদের কারণে, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে দেশটাকে আমরা নতুন বাংলাদেশ বলার সাহস করছি তাদের এই ত্যাগ কোনো নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের ইতিহাসের স্রষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনারা জীবন্ত ইতিহাস। মনের গভীর থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। যে জাতি ইতিহাস স্মরণ করতে পারে না সে জাতি, জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে না। এই স্বীকৃতিটা জাতির পক্ষ থেকে আমার আপনাদের কৃতজ্ঞতা।’

শহীদ পরিবার ও আহতের উদ্দেশে তিনি বলেন, আজ থেকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের অংশ হলেন। ‘এটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এর বাইরেও আপনাদের দায়িত্ব সমাজের সবাইকে গ্রহণ করতে হবে।’

Advertisement

এ সময় উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান।

বৈঠকে তিন শহীদ পরিবার ও তিনজন যোদ্ধা বক্তব্য দেন। তারা হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রাপ্তি, আর্থিক সহযোগিতা ও পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। জুলাইয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এসময় তাদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

বৈঠকে আহত ও শহীদ পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের জন্য সরকারের গৃহীত কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন ফেব্রুয়ারির শুরুতেই শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু জুলাই অভ্যুত্থানের ৮৩৪ জন শহীদের গেজেট প্রকাশ গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্মরণসভা করার নির্দেশ

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদরা ‘জুলাই শহীদ’ নামে অভিহিত হবেন এবং আহতরা ‘জুলাই যোদ্ধা’ নামে অভিহিত হবেন ও পরিচয়পত্র পাবেন।

প্রতিটি শহীদ পরিবার এককালীন ৩০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পাবে। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জুলাইয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি প্রতিটি শহীদ পরিবারকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করা হবে। শহীদ পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যরা সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন।

গুরুতর আহতদের ‘ক্যাটাগরি এ’ অনুযায়ী, এককালীন ৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তিন লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি গুরুতর আহত প্রত্যেক জুলাই যোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আজীবন চিকিৎসা সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন ও মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে দেশি-বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাবেন। তারা কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন সুবিধা পাবেন।

‘ক্যাটাগরি বি’ অনুযায়ী, জুলাই যোদ্ধাদের এককালীন তিন লাখ টাকা দেওয়া হবে; এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি মাসিক ১৫ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হবে; কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি/আধাসরকারি কর্মসংস্থান প্রাপ্য হবেন।

জুলাই যোদ্ধাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। তারা পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে সরকারের বিভিন্ন সুবিধা পাবেন। এখন পর্যন্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৮৩৪ জন শহীদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। এছাড়া আহতদের তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগির তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।

অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানি, আপনাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল আরও আগেই আমরা প্রাতিষ্ঠানিক কাজগুলো করতে পারবো। আমাদের আন্তরিকতা কম ছিল না। আমাদের প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের প্রত্যেকে আপনাদের ন্যায্য সম্মাননা দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন। সংকটকালীন আমাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে সে কারণে আপনাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আমরা করতে পারিনি। এ কারণে দুঃখপ্রকাশ করছি।’

এমইউ/এমএমএআর/জিকেএস