পাবনায় সেচের আওতায় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) স্থাপিত গভীর নলকূপের মালিকানা দাবির অভিযোগ উঠেছে লোকমান হোসেন নামের এক ব্যক্তি ও তার ছেলের বিরুদ্ধে। এতে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। সেচের অভাবে কয়েকশ বিঘা জমির ধান আবাদ বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি এর প্রতিবাদে অনাবাদি জমিতে মানবন্ধন করেছেন কৃষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নত সেচ ব্যবস্থায় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ১৯৮৪ সালে পাবনা সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের দুর্গারামপুর গ্রামে একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করে বিএডিসি পাবনা কার্যালয়। ঋণের মাধ্যমে দুর্গারামপুর উত্তরপাড়া কৃষক সমবায় সমিতিকে ৯৯ হাজার টাকায় এ নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়। চাষিদের এ ঋণের টাকা কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিয়ে বিএডিসিকে পুরো ঋণের টাকা পরিশোধ করে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি)। এরপর নলকূপ পরিচালনায় সমিতির অন্যতম সদস্য লোকমান হোসেনকে সমিতির ম্যানেজার নিযুক্ত করা হয়। পরে সমিতির রসিদে নলকূপ বা সমিতির আওতাধীন সদস্যদের থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা নিয়ে সমিতির পক্ষে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে বিআরডিবির মওকুফকৃত ঋণের ৯৯ হাজার টাকা পরিশোধ করেন লোকমান হোসেন। বিআরডিবি এ সংশ্লিষ্ট একটি প্রত্যয়নে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
কৃষকদের অভিযোগ, শুরুতে কিছুদিন ভালো চললেও ফসল, জমি ও কৃষকদের চাহিদামতো সেচের বিপরীতে লোকমানের স্বেচ্ছাচারিতা ও অব্যবস্থাপনায় সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। ফলে তাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন সমবায় সমিতির সদস্যরা। কিন্তু স্থানীয় সালিশ বৈঠকে প্রথমবারের মতো সংশোধনের সুযোগ দিয়ে পুনরায় তাকে ওই দায়িত্বে রাখা হয়। এরপর ঋণের টাকা নিজে পরিশোধ করেছেন উল্লেখপূর্বক এর মালিকানা দাবি করেন লোকমান। ১৯৯৯ সালে আদালতে ভুয়া মামলা করে তিনি কৃষক বা সমিতির সদস্যদের ওই গভীর নলকূপ ব্যবহারে বাধা দেন।
২০১০ সালে ওই মামলার রায় দেখিয়ে সম্পূর্ণ মালিকানা দাবি করে নলকূপের নিয়ন্ত্রণ নেন লোকমান হোসেন। সেচের পানি চাইলে কৃষকদের মারধরের ঘটনাও ঘটান লোকমান ও তার ছেলে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে স্থানীয়ভাবে সালিশি বৈঠকে সমিতির কাছে টাকা পাওনা দাবি করেন লোকমান হোসেন। পরে যাচাই-বাছাই শেষে ৩০ হাজার টাকা লোকমান সমিতির কাছে পাবেন বলে প্রতীয়মান হয়। সালিশে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট মেয়াদে সমিতি সেটি পরিশোধ করে। এ টাকা বুঝে পেয়ে সব দাবি ছেড়ে সমিতির কাছে নলকূপ হস্তান্তর করতে প্রতিশ্রুতি দেন লোকমান।
নলকূপ পরিচালনা সংক্রান্ত নতুন একটি কমিটি অনুমোদনের জন্য বিএডিসির কাছে আবেদন করা হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টে আবার নলকূপে নিজের মালিকানা দাবি করেন লোকমান ও তার ছেলে সেলিম রেজা। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে লোকমানের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে একটি মামলা করেছেন কৃষকরা।
এই নলকূপের আওতায় ছয় বিঘা জমি চাষ করেন জনি প্রামাণিক। ঠিকমতো পানি না পেয়ে লোকসানের আশঙ্কায় ধান চাষ বন্ধ রেখেছেন। অন্য ফসল চাষ করলেও বেশিরভাগ সময় অনাবাদিই থাকছে তার জমি।
আরও পড়ুন:
১০ ফসলের উৎপাদন খরচ খুঁজতে ভ্রমণ ব্যয়ই ১০ কোটি টাকা দিনাজপুরে লিচুর ফুল থেকে ১২০ কোটি টাকার মধু আহরণ সাতক্ষীরায় বাগদা চিংড়িতে মড়ক, চাষিরা হতাশজনি প্রমাণিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘জমিতে ঠিকমতো পানি দেয় না। পানির জন্য ওদের পেছন পেছন ঘুরতে হয়। এরপর ইচ্ছামতো ছাড়লেও অর্ধেক জমি ভিজে আর অর্ধেক জমি শুকনা থাকতেই পানি বন্ধ করে দেয়। এসব নিয়ে কথা বলায় লোকমান তার ছেলে ও লোক দিয়ে আমাকে মারধর করে।’ সমবায় সমিতির সদস্য কৃষক নান্নু প্রামাণিক বলেন, ‘নলকূপ আমরা কৃষকরা মিলে সমিতি করে নিয়েছি। প্রত্যেকে প্রতি বিঘা ৯০০ টাকা হারে সমিতির রসিদ কেটে চাঁদা দিয়ে কিস্তির টাকা পরিশোধ করেছি। সবাই সেসব রসিদ সংগ্রহে না রাখলেও কিছু রসিদ এখনো আছে। কিন্তু লোকমান ও তার ছেলের দাবি, টাকা তারা দিয়েছে, তাই নলকূপ তাদের। এটি কীভাবে সম্ভব?’
তিনি বলেন, ‘দু-একজন কৃষক ঠিক সময়ে হয়তো টাকা পরিশোধ করেনি। কিন্তু দেরিতে হলেও তারা টাকা দিয়েছে। অথচ সে (লোকমান) মামলা জালিয়াতি করে কৃষকের নলকূপ নিজের নামে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের সেচের পানি দেওয়া হয় না। আবাদ বন্ধ রয়েছে।’
কৃষক বাবুল হোসেন, মুকিম উদ্দিন প্রামাণিক, সৌরভ হোসেন ও আব্দুল হান্নানসহ আরও কয়েকজন জানান, অন্যরা প্রতি বিঘা জমি আবাদে ১৫০০-১৮০০ টাকা নিলে লোকমান ও তার ছেলে নেন ২৫০০-৩০০০ টাকা। ক্যানাল ভেঙে ইট নিজের বাড়ির কাজে লাগিয়েছেন। সেই ইট এখনো তাদের বাড়ির সামনে স্তূপ করে রাখা আছে।
ভুক্তভোগী কৃষকরা জানান, নলকূপের আওতায় শুরুতে আড়াইশ বিঘার মতো জমিতে চাষাবাদ হতো। লোকমান হোসেনের অত্যাচারে শতাধিক বিঘা জমি আশপাশের নলকূপে আবাদ করা হচ্ছে। ১৪০ বিঘার জায়গায় এখন আবাদ হচ্ছে মাত্র ২০-২৫ বিঘা। ঠিকমতো সেচ না দেওয়াসহ নানা অব্যবস্থাপনার জন্য শতাধিক বিঘা জমি অনাবাদি পড়ে আছে।
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেছেন অভিযুক্ত লোকমান হোসেন ও তার ছেলে সেলিম রেজা। সেলিম রেজা বলেন, শুরুতে নলকূপটি সমিতিকে দেওয়া হলেও ঋণের টাকা সমিতির কেউই না দেওয়ায় পরে আমরা এটি কিনে নিই। পরে আমাদের কাছ থেকে এটি ছিনিয়ে নিতে চাইলে আমরা আদালতে মামলা করি। মামলার রায় আমাদের পক্ষে।
পানি না দেওয়া বা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, প্রয়োজন অনুযায়ী সব জমিতেই পানি দেওয়া হয়। অনেক কৃষক ধান রেখে গম বা অন্যান্য আবাদে ঝুঁকেছেন। এরসঙ্গে পানি দেওয়ার সম্পর্ক নেই। একটি চক্র আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
এ বিষয়ে বিএডিসি পাবনা কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী (নির্মাণ) আফনান আজম রুদ্র বলেন, বিএডিসি এটি স্থাপন করলেও পরে কৃষক বা সমিতি পর্যায়ে হস্তান্তর করা হয়। এটির মালিক বিএডিসি, অন্য কারও হওয়ার সুযোগ নেই। তবে নলকূপটি নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা সেচ ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিংয়ে আমি তুলেছিলাম। জটিলতা নিরসনে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসআর/এমএস