দেশজুড়ে

উপকূলের প্লাস্টিক-পলিথিনের শেষ গন্তব্য সুন্দরবন

উপকূলের প্লাস্টিক-পলিথিনের শেষ গন্তব্য সুন্দরবন

* উপকূলের ব্যবহৃত পলিথিনি জোয়ার-ভাটায় চলে চায় সুন্দরবনে* ব্যবস্থাপনার অভাবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বোতল, প্যাকেট সুন্দর বনেই ফেলেন পর্যটকরা* প্রয়োজন সম্মিলিত সচেতনতা* ওয়ান টাইম প্লাস্টিক ব্যবহারে রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি

Advertisement

সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী এলাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে পলিথিনের ব্যবহার। স্থানীয়দের পাশাপাশি সুন্দরবন দেখতে আসা অনেক পর্যটকও খাবার ও পানীয় নিয়ে আসছেন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পাত্রে। খাবারের দোকান, চায়ের স্টল কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের প্লেট, কাপ ও চামচ ব্যবহার এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবহারের পর এসব ফেলে দেওয়া হচ্ছে পাশের নদী-খালে। আর জোয়ার-ভাটার স্রোতে এসব পৌঁছে যাচ্ছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে, যেখানে হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।

শ্যামনগরের উপকূলবর্তী আটুলিয়া, গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ ও কৈখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাজার ও বসতবাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক সামগ্রী। মুন্সিগঞ্জ, নওয়াবেঁকী বা নীলডুমুর বাজারে সকালে চা-পানের পর ফেলে রাখা প্লাস্টিকের কাপ, বিকেলের পর খাবারের প্লেট ও চিপসের প্যাকেটগুলো নদীর পাশেই জমে থাকে।

‘চরের ওপর আগাছা বা ছোট গাছ গজানোর সুযোগ থাকতো আগে। এখন সব প্লাস্টিকে ভর্তি, মাটি আটকে থাকে। চরে আর আগের মতো কোনো গাছ জন্মায় না।’

Advertisement

স্থানীয়দের ভাষ্য, এসব সামগ্রী সস্তা, দোকানে সহজলভ্য, আর ব্যবহার শেষে পরিষ্কার করার কোনো ঝামেলাও নেই। বিশেষ করে সামাজিক অনুষ্ঠান বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় দ্রুত গ্রাহক সেবা দিতে গিয়ে অনেকেই প্লাস্টিক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। ফলে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এই অপচনশীল বর্জ্য শেষ পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে পাশের নদী-খালে, সেখান থেকে সরাসরি সুন্দরবনের অভ্যন্তরে।

নদী হয়ে পলিথিনের গন্তব্য সুন্দরবন

সুন্দরবনের সীমানা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ, মালঞ্চ, চুনকুড়ি ও মাদার নদী এখন নিয়মিত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পলিথিনের বোঝা। নদীর পাড়ে থাকা শিশু ও কিশোরদের অনেকেই না জেনে বুঝেই নদীতে ফেলে দেয় ব্যবহৃত প্যাকেট, বোতল বা গ্লাস।

সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগরের দাতিনাখালী গ্রামের জেলে বাচ্চু হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, নদীতে জাল ফেললে এখন মাছের বদলে উঠে আসে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল আর পলিথিন। মাছও কমে গেছে আগের তুলনায়।

গাবুরার আশিক হোসেন বলেন, চরের ওপর আগাছা বা ছোট গাছ গজানোর সুযোগ থাকতো আগে। এখন সব প্লাস্টিকে ভর্তি, মাটি আটকে থাকে। চরে আর আগের মতো কোনো গাছ জন্মায় না।

Advertisement

‘আমরা চেষ্টা করি নিজেরা প্লাস্টিক না ফেলতে। কিন্তু ঘাটে বা বোটে কোনো ডাস্টবিন নেই। পানির বোতল বা খাবারের প্যাকেট কোথায় রাখবো, সেটাই বুঝি না।’

তিনি বলেন, আগে শুধু পলিথিন ছিল এখন পানির বোতলসহ নানা ধরনের ভারি প্লাস্টিকের পট ও প্যাকেটের ছড়াছড়ি। এসব নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না।

আরও পড়ুন-

সুন্দরবনে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা, দুশ্চিন্তায় হাজারও বনজীবী অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে ১০ সিদ্ধান্ত সুন্দরবনের ১০ কিমির মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ নিষিদ্ধ পর্যটকদের ভাষ্য

সুন্দরবন দেখতে আসা অনেক পর্যটকই জানেন না, প্লাস্টিক ব্যবহার এখানকার পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর। আবার কেউ কেউ সচেতন হলেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় নিজেরাই বাধ্য হন প্লাস্টিক ব্যবহার করতে।

ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে নীলডুমুর ঘাট দিয়ে সুন্দরবন দেখতে আসা পর্যটক রাকিব হাসান বলেন, আমরা চেষ্টা করি নিজেরা প্লাস্টিক না ফেলতে। কিন্তু ঘাটে বা বোটে কোনো ডাস্টবিন নেই। পানির বোতল বা খাবারের প্যাকেট কোথায় রাখবো, সেটাই বুঝি না।

রাজশাহী থেকে আসা কলেজ শিক্ষার্থী সামিয়া হক বলেন, সুন্দরবন খুবই সুন্দর জায়গা। কিন্তু নদীতে এত ময়লা ভাসতে দেখেছি, মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পর্যটকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, স্থানীয়রাও সচেতন না হলে বনের এই সৌন্দর্য একদিন হারিয়ে যাবে।

তবে অনেক পর্যটকই প্লাস্টিক ব্যবহারের বিকল্প চাচ্ছেন। তাদের দাবি, টুরিস্ট ট্রলারগুলোতে যদি কাঁচের গ্লাস বা মাটির কাপ ব্যবহার করা হতো, তাহলে আমাদের ভালো লাগত। আমরা প্লাস্টিক ব্যবহার করতে চাই না, কিন্তু পরিবেশবান্ধব কোনো ব্যবস্থাও দেখি না।

স্থানীয় ব্যবস্থাপনাকে দুষছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা

সুন্দরবন সংলগ্ন পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মতে, প্লাস্টিক দূষণের জন্য একমাত্র পর্যটকরা দায়ী নন, বরং স্থানীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই মূল কারণ।

নীলডুমুর ঘাটের পর্যটন ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের পর্যটকদের বারবার বলা হয়, প্লাস্টিক না আনতে বা ব্যবহারের পর সঙ্গে নিয়ে ফিরতে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সেটা মেনে চলে। কিন্তু স্থানীয় হাটবাজার থেকে যে পরিমাণ প্লাস্টিক নদীতে পড়ে, সেটা শতগুণ বেশি। সরকার যদি প্রতিটি বাজারে ডাস্টবিন ও বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করে, তাহলে সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়।

‘এটা শুধু বন বিভাগের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয়দের সম্মিলিতভাবে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, আমরাও চাই সুন্দরবন নিরাপদ থাকুক। আমাদের ব্যবসাও সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। তাই আমরা নিজেদের উদ্যোগে নদী পরিষ্কার অভিযান চালাই এবং পর্যটকদের সচেতন করার চেষ্টা করি। তবে সরকার ও বনবিভাগের অংশগ্রহণ ছাড়া ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব নয়।

এদিকে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সুন্দরবনের ভেতরে প্লাস্টিক বহন করে নিয়ে যাওয়া কিংবা ফেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমাদের বন প্রহরীরা নিয়মিত টহল দিয়ে পর্যটক ও জেলেদের তল্লাশি করে। এরপরও নদীপথে ভেসে আসা প্লাস্টিক সুন্দরবনের নদী খালে পৌঁছে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এটা শুধু বন বিভাগের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয়দের সম্মিলিতভাবে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। বন বিভাগ বছরে কয়েকবার পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালায় এবং স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক সভা করে।

রেঞ্জ কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরা চাই সুন্দরবন রক্ষা হোক। তবে এর জন্য শুধু অভিযান নয়, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও স্থানীয়দের অংশগ্রহণ জরুরি।

সচেতনতার ঘাটতি, ব্যবস্থাপনার অভাব

সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামীণ বাজার ও দোকান থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বের হয়, তার জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট ডাম্পিং ব্যবস্থা। অধিকাংশ বাজারেই নেই নির্ধারিত বর্জ্য সংগ্রহের পাত্র বা কর্মী।

সুন্দরবন সংলগ্ন বুড়িগোয়ালীনি বাজারের দোকানি আব্দুল হালিম জাগো নিউজকে বলেন, ঝাড়ু দিয়ে দিনের শেষে সব ময়লা পাশের নদীর চরে ফেলে দিই। আমাদের বাজারে আলাদা করে ময়লা ফেলার মতো কোনো জায়গা নেই। দোকানগুলো সব নদীর পাড়ে, ফলে যে যার মতো নদীতে ময়লা ফেলে।

জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সংগঠন সিডিও ইউথ টিমের সমন্বয়কারী গাজী আল ইমরান জাগো নিউজকে বলেন, এই অঞ্চলে প্লাস্টিক দূষণ এখন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। খাল-বিল হয়ে সুন্দরবনের গভীরে প্রবেশ করছে অপচনশীল এই বর্জ্য। এজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে উপকূলীয় এলাকার শিশুদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে যদি এখনই কাজ শুরু না হয়, ভবিষ্যতে এটি হবে অপূরণীয় ক্ষতি।

স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা

শুধু পরিবেশ নয়, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ঝুঁকি আছে স্বাস্থ্যেও। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জিকাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মোনয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের পাত্রে গরম খাবার রাখলে রাসায়নিক উপাদান খাবারে মিশে যায়। এতে পরবর্তীতে হজম সমস্যা, অ্যালার্জি এমনকি ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে।

সরকারি নজরদারির ঘাটতি

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকায় ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তবে নেই তার প্রয়োগ। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগেও নেই তেমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন।

এ বিষয়ে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী উপকূলীয় এলাকায় ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বা একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পরিবেশ রক্ষা আমাদের মূল দায়িত্ব হলেও জনবল ও অবকাঠামোগত সংকটের কারণে মাঠপর্যায়ে আমরা খুব বেশি তৎপরতা চালাতে পারি না। বিশেষ করে সুন্দরবন সংলগ্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নিয়মিত নজরদারি করা সম্ভব হয় না। তবে ওইসব এলাকায় বন বিভাগ নিয়মিত নজরদারি চালায়।

তিনি বলেন, আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বিভিন্ন হাটবাজারে সচেতনতামূলক সভা আয়োজন করছি এবং দোকানদারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি, যাতে তারা প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করেন। কিছু জায়গায় আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আইন প্রয়োগ করেছি, যদিও সংখ্যায় তা সীমিত। বর্তমানে আমাদের সচেতনতামূলক কার্যক্রমই বেশি, তবে জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে আইনের কঠোর প্রয়োগও করা হবে।

তিনি আরও বলেন, আসলে এখনও পলিথিন বা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না, কারণ এর সহজলভ্যতা ও সস্তা দাম মানুষকে পুরোনো অভ্যাস থেকে বের হতে দিচ্ছে না। টেকসই ও সুলভ বিকল্প না থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে পলিথিনই ব্যবহার করছে। এ সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ রক্ষায় করণীয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন

*উপকূলীয় প্রতিটি বাজারে নির্ধারিত বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা

*স্কুল ও মসজিদে নিয়মিত প্লাস্টিক বিরোধী সচেতনতামূলক শিক্ষা কার্যক্রম

*ওয়ান টাইম পণ্যের বিকল্প হিসেবে পাট, কাগজ ও মাটির তৈরি সামগ্রী সহজলভ্য করা

*স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে নদী ও চরে নিয়মিত পরিষ্কার কার্যক্রম করতে হবে।

*সরকারি পর্যায়ে প্লাস্টিকের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও জরিমানার ব্যবস্থা।

সুন্দরবন আমাদের জাতীয় গর্ব ও প্রাকৃতিক ঢাল। শুধু ক্যাম্পেইন নয়, বাস্তবভিত্তিক ও সমন্বিত উদ্যোগই পারে এই জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে।

এফএ/জেআইএম