অর্থনীতি

জুতা রপ্তানিতে উল্লম্ফন, প্রক্রিয়াজাত চামড়া-পণ্যে পতন

জুতা রপ্তানিতে উল্লম্ফন, প্রক্রিয়াজাত চামড়া-পণ্যে পতন

চামড়ার জুতা রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় ফিরলেও প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। চীনের বিকল্প হিসেবে জুতার জন্য ভালো উৎস হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। তবে চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রে রয়েছে নানান প্রতিকূলতা।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরিবেশগত অননুবর্তিতা, অর্থাৎ পরিবেশ রক্ষায় গৃহীত নিয়ম পালনে ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি ও টেকসই সরবরাহ চেইনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। অথচ দেশের অধিকাংশ ট্যানারি এখনো আন্তর্জাতিক পরিবেশ মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ।

আমরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় বাড়াতে পারছি না। বৈশ্বিক ক্রেতারা কমপ্লায়ান্সকে গুরুত্ব দেয় এবং তারা নন-কমপ্লায়ান্স কারখানা থেকে পণ্য কিনতে চায় না।- বিটিএ সভাপতি শাহীন আহমেদ

সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ অনুমোদনের ঘাটতির কারণে অনেক ক্রেতা বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়াজাত পণ্য এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে রপ্তানি বাজার সংকুচিত হচ্ছে এবং রাজস্ব আয়েও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

Advertisement

রপ্তানি আয়ের চিত্র

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্যানুসারে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের জুলাই থেকে মে সময়ে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। গত বছর একই সময়ে ছিল ৯৪০ মিলিয়ন ডলার।

প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ছিল চামড়ার তৈরি জুতা (লেদার ফুটওয়্যার) রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এ খাত থেকে রপ্তানি আয় ২৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেড়ে ৬২০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৮১ মিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটে তছনছ চামড়ার বাজার ৩৫ বছর পর কাঁচা-ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির সুযোগ কোরবানির চামড়া সংগ্রহে গরম নিয়ে দুশ্চিন্তা 

তবে চামড়া শিল্পের অন্য দুই উপখাত—প্রক্রিয়াজাত (ক্রাশড) চামড়া ও চামড়াজাত অন্য পণ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। ক্রাশড চামড়া রপ্তানি ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ কমে ১২০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৩০ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব কারখানা ও সার্টিফায়েড পণ্য তৈরির চাহিদা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ব্র্যান্ডিংয়ে বিনিয়োগ না করলে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।- বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন

Advertisement

একই সঙ্গে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৮ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩২৯ মিলিয়ন ডলার।

নীতিনির্ধারক ও সরকারি সংস্থাগুলো এ খাত সম্পর্কে অনিচ্ছুক। তারা এ খাতের চাহিদার প্রতি মনোযোগ দেয়নি। পরিবেশগত অসম্মতির কারণে দেশীয় উৎস থেকে বিপুল সুযোগ এবং কাঁচামাল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও আমরা এ সুযোগটি গ্রহণ করতে পারছি না।

কেন পিছিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাতটি সম্পূর্ণরূপে পরিবেশসম্মত করতে সরকার এটিকে হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত করেছে। তবে একটি কার্যকর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের অভাবে এটি এখনো সমস্যায় রয়েছে। যার কারণে আমরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় বাড়াতে পারছি না। বৈশ্বিক ক্রেতারা কমপ্লায়ান্সকে গুরুত্ব দেয় এবং তারা নন-কমপ্লায়ান্স কারখানা থেকে পণ্য কিনতে চায় না।’

শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীনে তৈরি চামড়ার জুতার দাম বেড়েছে। ফলে, বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা তাদের ক্রয় গন্তব্য বাংলাদেশে স্থানান্তরিত করেছেন। এ কারণেই বাংলাদেশ থেকে চামড়ার জুতা রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।- এলএফএমইএবি সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান

তিনি বলেন, ‘সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, কিন্তু এটি কার্যকরী হচ্ছে না। সরকার যদি আরও ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে, তবে এটি এ খাতের মানুষের জন্য উপকারী হতে পারে।’

শাহীন বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সরকার এ খাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করবে এবং এটিকে নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববাজারে পরিবেশবান্ধব কারখানা ও সার্টিফায়েড পণ্য তৈরির চাহিদা রয়েছে। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ব্র্যান্ডিংয়ে বিনিয়োগ না করলে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য টেকসই উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং ট্যানারিগুলো পরিবেশবান্ধব করার এখনই উপযুক্ত সময়।’

যে কারণে বাড়ছে চামড়ার জুতার রপ্তানি

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান বলেন, ‘শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীনে তৈরি চামড়ার জুতার দাম বেড়েছে। ফলে, বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা তাদের ক্রয় গন্তব্য বাংলাদেশে স্থানান্তরিত করেছেন। এ কারণেই বাংলাদেশ থেকে চামড়ার জুতা রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।’

ফিনিশড চামড়া আমদানি সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা যদি চামড়া কেনার জন্য কোনো দেশকে মনোনীত করেন, তাহলে আমরা তা উপেক্ষা করতে পারি না। সাধারণত, একজন ক্রেতা মান ও পরিবেশগত সমস্যার কারণে কোনো দেশ বা উৎপাদক মনোনীত করেন।’

চামড়ার পাদুকার শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি মূল্য সংযোজিত পণ্যে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক ভাব প্রতিফলিত করে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস