জাতীয়

এক-দেড় লাখে গরু, ২৫-৩০ হাজারে খাসি খুঁজছেন ক্রেতারা

এক-দেড় লাখে গরু, ২৫-৩০ হাজারে খাসি খুঁজছেন ক্রেতারা

নেত্রকোনা থেকে ১৪টি গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন ব্যাপারী আনোয়ার। গত ১ জুন গরুগুলো রাজধানীর মেরুল বাড্ডা হাটে তোলেন তিনি ও তার সহযোগীরা। চারদিনে মাত্র একটি গরু বিক্রি করতে পেরেছেন। বাকি ১৩টি এখনো অবিক্রীত। ভালো দামের প্রত্যাশায় গরু নিয়ে ঢাকা এলেও এখন হতাশা ঘিরে ধরেছে আনোয়ারের।

Advertisement

বুধবার (৪ জুন) বিকেলে আকারে ছোট একটি গরু নিয়ে হাটের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে হাঁকডাক করতে দেখা যায় তাকে। কথা বলে জানা যায়, এটিই তার কাছে থাকা গরুগুলোর মধ্যে থাকা সবচেয়ে ছোট।

বড় গরু রেখে ছোট গরু নিয়ে কেন হাটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন—এমন প্রশ্নে আনোয়ার বলেন, ‘কাস্টমারে (ক্রেতা) তো খোঁজে এক-দেড় লাখের গরু। আমার কাছে সব ২ লাখের ওপরে। এটা একটু ছোট। তাই আজ এটা নিয়ে সামনে দাঁড়াইছি। ১ লাখ ৬০ হলে ছেড়ে দেবো।’

আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলার সময় দুজন ক্রেতা তার গরুর দাম-দর করেন। বিক্রেতা আনোয়ার ও ক্রেতাদের কথা শুনে বোঝা যায়, দামের তফাৎ ৩০ হাজার। আনোয়ার ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ছাড়া বিক্রি করবেন না। আর ক্রেতারা ১ লাখ ৩০ হাজারের ওপরে দাম দিয়ে কিনবেন না।

Advertisement

গরু পছন্দ হলেও বাজেট নেই জানিয়ে ক্রেতা আজিম উদ্দিন ও সাব্বির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, এবার ২৭ থেকে ২৮ হাজার করে মণ দরে গরু কিনছে সবাই। সেই হিসাবে ৫ মণের গরুর দাম ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার হলে নেওয়া যায়। এটা ৫ মণের বেশি হবে না। ১ লাখ ৬০ দিয়ে কিনলে লস হবে।

শুধু আজিম উদ্দিন ও সাব্বির আহমেদ নন, অধিকাংশ ক্রেতার পছন্দ ছোট ও মাঝারি গরু। এক লাখ থেকে দেড় লাখের মধ্যে হাটে গরু খুঁজছেন তারা। ছোট ও মাঝারি আকারের গরু দ্রুত বিক্রি হচ্ছে। ফলে হাটে পড়ে থাকছে কিছুটা বড় আকারে গরু। এ নিয়ে নাখোশ দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা।

বিক্রেতারা বলছেন, ঢাকার হাটে বড় গরুর চাহিদা থাকে। সেজন্যই তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়তি পরিবহন খরচ দিয়ে বড় গরু ঢাকায় আনেন। অথচ ঢাকার মানুষই এবার ছোট গরু খুঁজছে, যা বিক্রেতাদের জন্য হতাশার।

মেরুল বাড্ডা হাট ঘুরে এবং ক্রেতা-বিক্রেতা ও হাটের ইজারাদারদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ইজারাদার ও হাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা জানান, এবার এ পশুর হাট শুরু থেকেই বেশ জমজমাট। আফতাবনগরে হাট না বসানোয় আশপাশের মানুষ মেরুল বাড্ডা হাটে গরু কিনতে আসছেন। এতে ক্রেতার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

Advertisement

হাট পরিচালনার দায়িত্বে থাকাদের একজন হাসনাইন খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে হাটে অনেক গরু এসেছে। ক্রেতাও ভালো। ব্যাপারী যারা বাইরে থেকে এসেছেন, তাদের নিরাপত্তায় আমরা যথেষ্ট ভালো ব্যবস্থা নিয়েছি। সবাই নির্বিঘ্নে বেচাবিক্রি করছেন।’

হাসনাইন খান বলেন, ‘আমাদের এ হাটে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার গরু এবং এক হাজারের মতো খাসি আসছে। বিক্রিও ভালো। প্রতিদিন ৩০০-৪০০ গরু বিক্রি হচ্ছে। শেষ দুদিনে (বৃহস্পতি ও শুক্রবার) আরও বেশি বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’

বড় গরুতে ‘অনীহা’, নাখোশ বিক্রেতারাগ্রাম ও জেলা শহরের হাটগুলোতে বড় গরু বিক্রি হয় কম। ঢাকায় অনেক ধনী মানুষের বাস। তারা বড় গরু কিনে থাকেন। সামর্থ্য থাকায় তারা টাকার পরিমাণের দিকে না তাকিয়ে বড় ও পছন্দসই গরু কেনেন। দীর্ঘদিন ঢাকায় গরু এনে বিক্রি করা ব্যাপারীদের এমনটিই ধারণা ছিল। তা এবার কিছুটা হলেও বদলে গেছে। এতে মন খারাপ বিক্রেতাদের।

কোরবানির ঈদ এলেই বড় গরু নিয়ে ঢাকায় আসেন সাইদুল ইসলাম, আজিবর মিয়া ও রমজান আলী। তিনজনই সিরাজগঞ্জ সদর এলাকার বাসিন্দা। একসঙ্গে ব্যবসা করছেন ১০ বছর। এরমধ্যে ৮ বছরই ঢাকায় কোরবানির ঈদে গরু নিয়ে আসেন তারা।

সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরের মানুষ বড় গরু দেখে চলে যায়, এইডা মানা যায় না। দুই লাখের গরু দেখে কই, এক লাখে হইবো? কেউ কেউ তো এমন দাম কইতেছে যে, মাথাডা গরম হয়ে যাচ্ছে।’

আরেক ব্যাপারী রমজান আলী বলেন, ‘তিনমাস আগে গরু কিনে লালনপালন করছি। অথচ কেনা দামের চেয়েও কম দাম কইতেছে। গরু বেচবো না, গ্রামে নিয়ে গিয়ে রাখবো। আগামী ঈদে আরও বড় করে বেচতে আসবো।’

আফতাবনগরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার শামীম হোসেন। এক ভবনে সবাই ব্যাংকের চাকরিজীবী। তারা পাঁজন মিলে ভাগাভাগি করে কোরবানি দেবেন। প্রত্যেকের বাজেট ২৫-৩০ হাজার। সেই হিসাবে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার গরু কেনার উদ্দেশ্যে মেরুল বাড্ডা হাটে এসেছেন শামীম ও তার তিন ভাগিদার।

শামীম হোসেন বলেন, ‘এবার গরুর দাম কম এটা সত্য। কিন্তু দাম যতই কম হোক, দেখে-শুনে তো নিতে হবে। আগে একদিন এসে ফিরে গেছি। এখন তো আর সময় নেই। আজ অথবা কালকের মধ্যে কিনে ফেলতে হবে।’

তার সঙ্গে থাকা ভাগিদার আরমান বলেন, প্রত্যেকে ৩০ হাজার করে দেড় লাখ টাকা বাজেট করেছি। আমরা ১ লাখ ৩০-৩৫ হাজার টাকার মধ্যে গরু কিনবো। বাকিটা গরু রাখা ও জবাই-কাটাকাটিতে খরচ হবে। কিন্তু যেসব গরু পছন্দ হচ্ছে, সেগুলোর দাম সব দুই লাখ চাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ দেখে বাজেটের মধ্যে একটা কিনে নিয়ে যাবো।’

২৫-৩০ হাজারের খাসির চাহিদা বেশিমেরুল বাড্ডা পশুর হাটে গরুর পাশাপাশি কোরবানির পশু হিসেবে খাসিও উঠছে অনেক। এরমধ্যে কেউ কেউ ভিন্ন জাতের খাসি এনেছেন। সেগুলোর দাম বেশি। শখ করে কিনে যদি কেউ কোরবানি দিতে চান, তাহলে তাকে স্বাভাবিক দামের চেয়ে বেশি টাকা গুনতে হবে।

তবে সাধারণ ক্রেতারা ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে কোরবানির খাসি খুঁজছেন। অনেকে দাম-দরে মিলে যাওয়ায় কিনতেও দেখা যায়। হাটের প্রবেশপথের পাশেই খাসি রাখা হয়েছে। বুধবার সেখানে ২০-২৫ মিনিট দাঁড়িয়ে অন্তত ১০টি খাসি বিক্রি হতে দেখা যায়।

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০-২২ কেজি ওজনের খাসির দাম ২৮-৩০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে। কিছুটা দাম-দর করে বনিবনা হলে বিক্রি করে দিচ্ছেন তারা।

তবে একজন ক্রেতা ৭১ ও ৭৫ কেজি ওজনের দুটি খাসি হাটে এনেছেন। সবার নজর এ দুটি খাসির দিকে। খাসির মালিক আব্দুল ওহাব বলেন, ‘খাসি দুটির মধ্যে ছোট যেটি, তার দাম হাঁকছেন ৮৫ হাজার এবং বড়টা ৯০ হাজার টাকা। কিছুটা কমে হলেও দ্রুত বিক্রি করে দিতে চান তিনি।’

কোরবানির পশু হিসেবে খাসি কিনতে এসেছেন রামপুরার উলনরোড এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম। তিনি ২৫ হাজার টাকা বাজেট করেছেন। সিরাজুল জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারের মোট সদস্য পাঁচজন। তার মধ্যে চারজনই গরুর মাংস খান না। এজন্য প্রতিবছর খাসি কোরবানি দিই।

তিনি বলেন, ‘এবার দামটা ওত বেশি মনে হচ্ছে না। আজকেই প্রথম এসেছি। পছন্দ হলে আজকেই নিয়ে যাবো। রোজ রোজ হাটে আসলে আরও কনফিউজড (দ্বিধান্বিত হয়ে পড়া) হয়ে যাবো। তখন কোনটা রেখে কোনটা কিনবো ভাবতে গিয়ে আরও লসে কিনতে হবে।’

এএএইচ/এমএএইচ/জিকেএস