মতামত

সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার

সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার

প্রতি বছর ৫ জুন, পৃথিবীজুড়ে বেজে ওঠে এক বিশেষ সুর, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় প্রকৃতির প্রতি আমাদের অমোঘ দায়িত্বের কথা। এই দিনটিই হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এটি কেবল একটি ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানো নয়, বরং মানবজাতিকে পরিবেশের প্রতি তাদের গভীর দায়বদ্ধতা এবং কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ্য। 'সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার'—এই প্রতিজ্ঞা হোক আমাদের প্রতিটি দিনের মূলমন্ত্র, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের চালিকাশক্তি। কারণ, এই পৃথিবীই আমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল, আর এর সুস্থতা আমাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। আসুন, এই বিশেষ দিনে আমরা সকলে মিলে নিজেদের এই পবিত্র অঙ্গীকারের কথা আরও একবার দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করি এবং এটিকে বাস্তব রূপ দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হই।

Advertisement

কেন সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার জরুরি?

আমরা এমন এক সংকটময় মুহূর্তে বসবাস করছি যেখানে পরিবেশের ওপর মানুষের কার্যকলাপের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প বিপ্লবের অনিয়ন্ত্রিত প্রসার এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা—এসবই পরিবেশের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। এর ফলে বন উজাড়, নদী দূষণ, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন—এর মতো সমস্যাগুলো প্রকট হচ্ছে। এই সমস্যাগুলো কেবল প্রাকৃতিক পরিবেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমরা সকলে মিলে সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার করি। এই অঙ্গীকার হোক আমাদের প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি সমাজে, প্রতিটি দেশে এবং বিশ্বজুড়ে এক নতুন জাগরণের প্রতীক। কারণ, পৃথিবী আমাদের হাতেই, আর এর সুস্থতা নির্ভর করে আমাদের সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। আমরা যদি আজ বীজ বুনি, তবে আগামী প্রজন্ম তার ফল ভোগ করবে। একটি সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার এই মহৎ কাজে আমরা সবাই অংশীদার হই।

Advertisement

জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বরং একটি বাস্তবতা। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন—বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলজ প্রাণীর প্রজনন ও খাদ্যচক্র ব্যাহত হচ্ছে। যদি আমরা এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা এক অসুস্থ ও বাসযোগ্যতাহীন পৃথিবী রেখে যাব। তাই, সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার কেবল একটি মহৎ ধারণা নয়, এটি আমাদের টিকে থাকার জন্য একটি জরুরি প্রয়োজন।

সবুজ পৃথিবী কী বোঝায়?

একটি সবুজ পৃথিবী মানে কেবল অগণিত গাছ লাগানো নয়। এর অর্থ আরও গভীর এবং ব্যাপক। এর মানে হলো একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র, যেখানে প্রতিটি জীব তার নিজস্ব পরিবেশে নির্বিঘ্নে টিকে থাকতে পারে। এর মানে হলো পরিষ্কার বায়ু, যা আমরা প্রতিদিন শ্বাস নিই; বিশুদ্ধ জল, যা আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। এর মানে হলো টেকসই উন্নয়ন, যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদ সংরক্ষণ নিশ্চিত করে।

সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকারের মধ্যে রয়েছে:জীববৈচিত্র্য রক্ষা: প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণী পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের বিলুপ্তি সামগ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।

Advertisement

প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার: জল, মাটি, খনিজ সম্পদ এবং বনভূমি—এগুলো আমাদের অমূল্য সম্পদ। এদের অপচয় রোধ করে, পুনর্ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য উৎসের ওপর জোর দিয়ে এদের সংরক্ষণ করতে হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ: বায়ু, জল এবং মাটি দূষণ রোধ করে পরিবেশের গুণগত মান বজায় রাখা।

নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার: জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, এবং ভূ-তাপীয় শক্তির মতো নবায়নযোগ্য উৎসের ব্যবহার বৃদ্ধি করা।

পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন: দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিবর্তন এনে পরিবেশের ওপর চাপ কমানো।

আমাদের অঙ্গীকার ও করণীয়: ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা

সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত—উভয় ধরনের প্রচেষ্টা অপরিহার্য। প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ, যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ দ্বারা নেওয়া হয়, তখন তা এক বিশাল আন্দোলনে রূপ নেয়।

ব্যক্তিগত উদ্যোগ:

গাছ লাগাই, গাছ বাঁচাই: এটি সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায়। প্রতিটি জন্মদিনে, বিশেষ অনুষ্ঠানে অথবা নিয়মিতভাবে গাছ লাগানোর অভ্যাস গড়ে তুলি। শুধু গাছ লাগালেই হবে না, সেগুলোর সঠিক যত্নও নিতে হবে যাতে সেগুলো বেড়ে উঠে। বৃক্ষরোপণ অভিযানকে শুধু সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ না রেখে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। আপনার বাড়ির আঙিনায়, ছাদে, বা বারান্দায় ছোট গাছ লাগান। প্লাস্টিকের ব্যবহার বর্জন: একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, স্ট্র, থালা-বাসন ইত্যাদির ব্যবহার পরিহার করে পরিবেশবান্ধব বিকল্প যেমন—কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ, ধাতব বোতল, কাঁচের পাত্র ব্যবহার করা উচিত। কেনাকাটার সময় নিজের ব্যাগ সঙ্গে রাখুন।

বিদ্যুৎ ও জলের সাশ্রয়: আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ ও জলের অপচয় বন্ধ করতে হবে। অপ্রয়োজনে আলো জ্বালিয়ে রাখা, ফ্যান চালানো বা কল খোলা রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী সরঞ্জাম (LED লাইট, এনার্জি-এফিশিয়েন্ট অ্যাপ্লায়েন্সেস) ব্যবহার করুন। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুন এবং শৌচাগারে কম জল ব্যবহার করুন।

বর্জ্য হ্রাস ও পুনর্ব্যবহার: 'রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকেল'—এই তিন নীতি মেনে চলতে হবে।

রিডিউস (হ্রাস): অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা কমিয়ে বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস করুন।

রিইউজ (পুনর্ব্যবহার): যে জিনিসপত্র একবার ব্যবহার করেছেন, তা ফেলে না দিয়ে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করুন। যেমন, পুরোনো পোশাক বা আসবাবপত্র দান করুন।

রিসাইকেল (পুনর্ব্যবহার): প্লাস্টিক, কাগজ, কাচ, ধাতব পদার্থ—এগুলো আলাদা করে সংগ্রহ করে রিসাইক্লিংয়ের জন্য দিন। বাড়িতে কম্পোস্ট তৈরি করে জৈব বর্জ্যকে সারে রূপান্তর করুন।

পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবার, বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় তাদের উৎসাহিত করতে হবে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা, সেমিনার বা কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। ছোটদের মধ্যে শৈশব থেকেই পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ তৈরি করা উচিত।

যানবাহনের সঠিক ব্যবহার: ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে হেঁটে, সাইকেল চালিয়ে বা গণপরিবহন ব্যবহার করে কার্বন নিঃসরণ কমানো যেতে পারে। স্বল্প দূরত্বের জন্য সাইকেল চালানো একটি চমৎকার অভ্যাস। সম্ভব হলে ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার শুরু করুন।

সম্মিলিত উদ্যোগ:

সরকারি নীতি ও আইনের কঠোর প্রয়োগ: পরিবেশ রক্ষায় সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন ও নীতির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দূষণকারী শিল্প-কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনে উৎসাহ দিতে হবে।

শিক্ষা ও গবেষণা: পরিবেশ শিক্ষা স্কুলকলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে এবং এর প্রতি দায়িত্বশীল হয়। পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার: জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, এবং ভূ-তাপীয় শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারের উচিত নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদনে বিনিয়োগ করা এবং এর ব্যবহারকে সহজলভ্য করা।

স্থানীয় পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া: আমাদের আশপাশের পরিবেশ, যেমন—নদী, পুকুর, খাল, খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। স্থানীয়ভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিং ড্রাইভের আয়োজন করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে পরিবেশ সংক্রান্ত চুক্তি ও উদ্যোগগুলোকে সমর্থন করতে হবে।

কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR): বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে তাদের উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করতে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করতে হবে। পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের (EIA) মাধ্যমে শিল্প স্থাপনের অনুমতি দেওয়া উচিত।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবুজ পৃথিবীআমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি, তা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া একটি আমানত, এবং এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করার দায়িত্ব আমাদেরই। যদি আমরা এখনই সচেতন না হই এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তাহলে আমরা তাদের জন্য এক চরম প্রতিকূল এবং বাসযোগ্যতাহীন পৃথিবী রেখে যাব।পরিবেশ আন্দোলনকে আর কোনো ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে দেখা যাবে না; এটি এখন আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। প্রতিটি দিনকে পরিবেশ দিবস হিসেবে ভাবতে হবে এবং প্রতিদিন পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস, আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের কথা মাথায় রাখতে হবে।আসুন, এই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমরা সকলে মিলে সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার করি। এই অঙ্গীকার হোক আমাদের প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি সমাজে, প্রতিটি দেশে এবং বিশ্বজুড়ে এক নতুন জাগরণের প্রতীক। কারণ, পৃথিবী আমাদের হাতেই, আর এর সুস্থতা নির্ভর করে আমাদের সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। আমরা যদি আজ বীজ বুনি, তবে আগামী প্রজন্ম তার ফল ভোগ করবে। একটি সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার এই মহৎ কাজে আমরা সবাই অংশীদার হই।

লেখক : গবেষক। sadia15.jnu@gmail.com

এইচআর/এএসএম