দেশজুড়ে

সিন্ডিকেটের কবলে চামড়া বাজার, হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

সিন্ডিকেটের কবলে চামড়া বাজার, হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

এবারও সিন্ডিকেটের কবলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার মোকাম রাজারহাটের চামড়া ব্যবসা। দাম বৃদ্ধি করে চামড়ার মূল্য নির্ধারণের ঘোষণার ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারাতে বসেছেন ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

Advertisement

তারা বলছেন, সরকারের মূল্য নির্ধারণে মাঠ পর্যায়ে তারা বাড়তি দামে চামড়া কিনেছেন। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাড়তি মূল্য দিচ্ছেন না। আর পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, ‘সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও সরকার তো চামড়া কেনে না। ট্যানারি মালিকরা যেভাবে দাম দেবে, সেভাবেই চামড়ার বেচাকেনা করতে হবে।’

মঙ্গলবার (১০ জুন) কোরবানি ঈদ পরবর্তী প্রথম হাটে এই চিত্র উঠে এসেছে। গত বছরও ঈদ পরবর্তী হাটে একই চিত্র বিরাজ করেছে। তবে ব্যবসায়ী আগামী শনিবারের (১৪ জুন) বড় হাটের দিকে তাকিয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার যশোরের রাজারহাট। ঢাকার পরে দেশের অন্যতম বৃহত্তর চামড়ার মোকাম এটি। এ মোকামে তিন শতাধিক আড়ৎ রয়েছে। সপ্তাহে দুদিন শনিবার ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। এখানে খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর এবং ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচাকেনা করেন।

এ হাট ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার ছোট বড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। প্রতি বছর কোরবানির ঈদ ঘিরে কয়েকটি হাটবারে রাজারহাটে প্রায় শত কোটি টাকার চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে।

Advertisement

মঙ্গলবার (১০ জুন) ছিল কোরবানি ঈদ পরবর্তী প্রথম হাট। তবে বড়হাট শনিবার হওয়ায় এদিন ব্যবসায়ীরা মূলত বাজার যাচাইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে গরু ছাগলের চামড়ার আমদানি ছিল তুলনামূলক বেশ কম। এদিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় পরিবহনে করে চামড়া এনে স্তূপ করে রেখেছেন। আবার স্থানীয় আড়তদাররা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্তূপ করা চামড়া উল্টে-পাল্টে দেখছেন। দাম নিয়ে চলছে দু’পক্ষের দর কষাকষি। আড়তদারদের দামে হতাশা প্রকাশ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, হাটে কোরবানির পশুর চামড়ার যে দাম, তাতে তারা পুঁজি হারাতে বসেছেন। মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ৪শ’ থেকে ৬শ’ এবং বড় চামড়া সর্বোচ্চ ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ছাগলের চামড়া দাম প্রতি পিস ২০ থেকে ৩০ টাকা। অথচ মাঠ পর্যায় থেকে তারা এর কমপক্ষে দেড়গুণ ব্যয় করে চামড়া হাটে নিয়ে এসেছেন। তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া। মূলত ট্যানারি মালিক-আড়তদারদের সিন্ডিকেট এ চামড়ার দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে তারা পূঁজি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কোলা দিঘলিয়া গ্রাম থেকে ১০০ পিস গরুর চামড়া নিয়ে হাটে এসেছিলেন অলোক বিশ্বাস।

তিনি জানান, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করা, লবণ লাগানো এবং পরিবহন খরচ মিলিয়ে চামড়ার দাম প্রতি পিস পড়েছে ৮শ’-৯শ’ টাকা। সেই চামড়া ৭শ’ থেকে সাড়ে শ’ টাকার বেশি দাম উঠছে না। বাধ্য হয়ে সাড়ে শ’ টাকা করে বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রতিপিস চামড়ায় গড়ে দু’শ টাকা লোকসান। এর সঙ্গে তার জন্য খরচও রয়েছে।

অলোক বিশ্বাস জানান, দাম বাড়িয়ে সরকারের চামড়ার মূল্য নির্ধারণের ঘোষণায় গৃহস্থরা মাঝারি আকারের চামড়াও ৫শ’-৬শ’ টাকার নিচে বিক্রি করতে রাজী হননি। এ দামে কিনে লবণ, শ্রমিক ও পরিবহণ ব্যয় করে দাম পড়েছে ৮০০-৯০০ টাকা। সরকারের দামে চামড়া কিনে এখন তাদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।

Advertisement

মাগুরার সীমাখালি থেকে গরুর চামড়া নিয়ে রাজারহাটে এসেছিলেন নির্মল দাস। তিনি জানান, বাজার বুঝতে ছোট ও মাঝারি আকারের ৩৫টি গরুর চামড়া এনেছেন। চামড়া কেনা, লবণ ও পরিবহন ব্যয় দিয়ে প্রতি পিসের দাম ৫০০ টাকার বেশি পড়েছে। হাটে ৩০০ টাকার বেশি কেউ দাম বলছে না।

সদর উপজেলার বসুন্দিয়া এলাকার বখতিয়ার হোসেন একশ পিস ছাগলের চামড়া নিয়ে হাটে এসেছেন। তিনি জানান, বড় আকারের ছাগলের চামড়া খরচ খরচা মিলিয়ে ৯০ টাকা পড়েছে। হাটে দাম উঠেছে ৩০-৪০ টাকা। আর ২৮ পিস গরুর চামড়া এনেছেন, যার খরচ পড়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। দাম উঠছে ৪০০ টাকা করে।

রাজারহাটে চামড়া কিনতে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী এসএম শামীম ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা দামে দুই হাজার পিস চামড়া কিনেছেন। তিনি জানান, ট্যানারি মালিকরা যে দামে কিনছেন, সেই হিসাব করে চামড়া কিনতে হচ্ছে। কারণ চামড়া তো ট্যানারিতেই বিক্রি করতে হবে। ফলে বাড়তি দামে কিনলে লোকসানের আশঙ্কা আছে।

রাজারহাটের আড়তদার হাসিব চৌধুরী ৫০০ থেকে সাড়ে ৯০০ টাকা দরে ৩০০ চামড়া কিনেছেন। তিনি জানান, সরকার দাম বাড়িয়ে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু সরকার তো আর চামড়া কেনে না। চামড়া কেনে ট্যানারি মালিকরা। তাই তাদের সঙ্গে কথা বলে দাম নির্ধারণ করেছে বলে মনে হয় না। ট্যানারি মালিকরা যে ধরনের দাম দিচ্ছে, হাটেও সেই দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে আগামী শনিবার বড় হাট রয়েছে, সেদিন অনেক বড় ব্যবসায়ী, পাইকার ও ট্যানারির প্রতিনিধিরা চামড়া কিনতে হাটে আসবেন। সেদিন বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে।

রাজারহাটের আরেক চামড়া ব্যবসায়ী খুরশীদ আলম বাবু জাগো নিউজকে জানালেন, ঈদ পরবর্তী প্রথম হাটের চামড়ার দাম সরকার নির্ধারিত দামের ধারে-কাছেও নেই। ফলে সরকারের ঘোষণায় মাঠ থেকে থেকে বাড়তি দামে চামড়া কিনে ছোট ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বড় লসের মুখে পড়েছেন। আর প্রথম এই হাটে বেশি ক্রেতা না আসায় কেনার প্রতিযোগিতা নেই। ফলে বাজারও বাড়ছে না।

বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি সাঈদ আহমেদ নাসির শেফার্ড বলেন, মঙ্গলবার প্রথম ও ছোট হাট হওয়ায় এদিন ছয় হাজারের মতো গরুর চামড়া উঠেছিল। তবে বাজার বেশ নিম্নমুখী। বেশির ভাগই চামড়াই ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। এতে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। মূলত সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে বাজারের সামঞ্জস্যতা নেই বলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে আগামী শনিবারের হাটের দিকে সবাই তাকিয়ে আছেন। এদিন প্রচুর চামড়া আমদানি যেমন হবে, তেমনি ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ী-আড়তদাররা আসবেন; আবার ট্যানারির লোকজনও আসবেন। কেনা-বেচার প্রতিযোগিতা বাড়লে দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মিলন রহমান/আরএইচ/এমএস