জাতীয়

৩৮ দিন ধরে অচল নগর ভবন, সেবা বঞ্চিত কোটি মানুষ

৩৮ দিন ধরে অচল নগর ভবন, সেবা বঞ্চিত কোটি মানুষ

রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান, পেশায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তার পাঁচ বছরের ছেলেকে একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করাতে চান। কিন্তু ছেলের জন্মসনদ না থাকায় বিপত্তি। জন্মসনদের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে থাকা অঞ্চল-১-এর কার্যালয়ে একাধিকবার গেছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই তাকে নগর ভবনের সামনে থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

বংশালের কাজী আলাউদ্দিন রোডে তিনমাস আগে একটি খাবারের দোকান চালু করেন ইমতিয়াজ আহমেদ। এ দোকানের ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য বুধবার (১৮ জুন) দুপুরে নগর ভবনে অঞ্চল-৪ এর কার্যালয়ের সামনে যান তিনি। কিন্তু ভবনের ফটকে তালা ঝুলতে থাকায় তিনি আর ভেতরে ঢুকতে পারেননি।

আরেক ভুক্তভোগী যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক রোডের একটি চারতলা বাড়ির মালিক রেজাউল করিম। বাড়ির বকেয়া হোল্ডিং কর দিতে সায়েদাবাদে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক অফিসে যান তিনি। কিন্তু গিয়ে দেখেন এ আঞ্চলিক অফিসের ফটকেও তালা লাগানো। কর্মদিবসেও কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস করছেন না।

নাগরিক সেবার এমন বেহাল দশা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)।

Advertisement

নাগরিকদের অভিযোগ, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা ৩৮ দিন (১৪ মে থেকে) ধরে নগর ভবনে তালা ঝুলিয়ে রেখেছেন তার সমর্থকরা। এ আন্দোলনের কারণে ঢাকা দক্ষিণের প্রায় এক কোটি মানুষ নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত। করপোরেশনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে সংস্থাটিতে জন্মনিবন্ধন সনদ, ট্রেড লাইসেন্স সনদ বিতরণসহ সব ধরনের নাগরিক সেবা কার্যক্রম বন্ধ।

আরও পড়ুন: নগর ভবনে বৈঠক করলেন ইশরাক, নামের আগে ‘মাননীয় মেয়র’ করোনা ও ডেঙ্গুর সঙ্গে ভোগাচ্ছে চিকুনগুনিয়াও ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে ঢাকার ৫৬টি ওয়ার্ড: জরিপ ইশরাক সমর্থকদের রাতভর অবস্থানের পর সকালেও বিক্ষোভ অব্যাহত

এছাড়া একই কারণে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশক নিধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মীরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। মশক নিধন কার্যক্রমও মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ নগরে এডিস মশার উপদ্রব ক্রমেই বাড়ছে। এছাড়া নগর ভবন বন্ধ থাকায় ঢাকা দক্ষিণের অনেক এলাকায় সড়কবাতি জ্বলছে না। সন্ধ্যার পরপরই সড়কে ঘুটঘুটে আঁধার নেমে আসছে। জলাবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রম থমকে আছে।

১০৯ দশমিক ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ডিএসসিসি গঠিত। এখানে ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন ওয়ার্ড ৭৫টি। এসব ওয়ার্ডে প্রায় এক কোটি মানুষ বাস করে। এর মধ্যে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষ ডিএসসিসির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে যান। পৃথক ১০টি অঞ্চলেও হাজারো মানুষ নাগরিক সেবা নিতে যান।

ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশন থেকে জন্মসনদ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, মৃত্যু-ওয়ারিশ সনদ বিতরণসহ ২৮ ধরনের নাগরিক সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া ডিএসসিসি পরিচালিত হাসপাতালের কার্যক্রম, সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত মেরামত, বাজার, ব্যায়ামাগার, কমিউনিটি সেন্টার, মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, রাস্তার গাড়ি পার্কিং, গ্রন্থাগার, বাস টার্মিনাল, পাবলিক টয়লেট, পার্ক-খেলার মাঠ, হোল্ডিংয়ের নামজারি, কবরস্থান ব্যবস্থাপনা, কমিউনিটি সেন্টার বুকিং, বহুতল ভবনের অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু চলমান আন্দোলনের কারণে বন্ধ এসব সেবা কার্যক্রম।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিএসসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে নাগরিকদের জন্মসনদ বিতরণ করে সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে অঞ্চল-১ ও অঞ্চল-৪ এর কার্যালয় নগর ভবনে। বাকি আটটি অঞ্চলের কার্যক্রম ঢাকার বিভিন্ন অফিস থেকে পরিচালিত হয়। কিন্তু ইশরাক হোসেনের মেয়র পদে শপথকে কেন্দ্র করে নগর ভবনসহ সবগুলো আঞ্চলিক অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন তার সমর্থকরা। শনিবার (২১ জুন) বেলা ১১টা পর্যন্ত এ তালা খোলা হয়নি।

সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বেলা ১১টা থেকে নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন ইশরাকের সমর্থকরা। তারা নগর ভবনের প্রধান ফটকসহ ভেতরে ঢোকার প্রতিটি ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাইরে থেকে সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকরা ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। এছাড়া নগর ভবনের ১১ তলায় থাকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অফিসেও কেউ ঢুকতে পারছেন না। উল্টো এ মন্ত্রণালয় বিএনপি নেতা ইশরাক হোসনকে শপথ না পড়ানোয় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে স্লোগান দেন তারা।

এছাড়া লালবাগে ডিএসসিসির অঞ্চল-৩, সায়েদাবাদে অঞ্চল-৫, খিলগাঁওয়ে অঞ্চল-২ এর কার্যালয়ে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। এসব দপ্তরেও কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অফিস করতে দেখা যায়নি। ফলে সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন নাগরিকরা।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় অঞ্চল-৩-এর কার্যালয়ে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নিতে যান কামরাঙ্গীরচরের মাদবরবাজার এলাকার বাসিন্দা কাদের খান। কিন্তু অফিসে তালা দেখে তিনি ফিরে যান।

আলাপকালে কাদের খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্সের জন্য গত এক মাসে তিনবার আঞ্চলিক কার্যালয়ে যাই। কিন্তু প্রত্যেকবারই দেখি কার্যালয়ে তালা লাগানো। মেয়র হওয়ার জন্য নাগরিক সেবা বন্ধ করে এ আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।’

আজিমপুর মোড় থেকে হাজারীবাগের সেকশন পর্যন্ত সড়কটি দিয়ে কামরাঙ্গীরচরের মানুষ যাতায়াত করে। প্রায় দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই পথে শতাধিক সড়কবাতির খুঁটি রয়েছে। কিন্তু রাতে তার প্রায় অর্ধেক জ্বলে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

তাদের অভিযোগ, এমনিতে সড়কবাতি নষ্ট হলে কিছুদিন পরপরই তা ঠিক করতো সিটি করপোরেশনের লোকজন। কিন্তু এক মাস ধরে তাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সন্ধ্যার পর সড়কে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে। পথচারীদের চলাচলে সমস্যা হয়।

আরও পড়ুন: রাজপথ না ছাড়ার নির্দেশ ইশরাকের মৎস্য ভবন-কাকরাইল এলাকায় ইশরাক সমর্থকদের অবস্থান ডিএসসিসির নগর ভবনে তালা, অফিসে যাননি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ইশরাকের মেয়র হওয়া না হওয়ার অনিশ্চয়তা

খিলগাঁওয়ের সি-ব্লকের একটি জমি বিক্রি সংক্রান্ত কাজে ওয়ারিশ সনদের জন্য ঘুরছেন আবুল কালাম। কিন্তু ওয়ার্ড অফিস, আঞ্চলিক অফিস বন্ধের কারণে সনদ নিতে পারছেন না তিনি।

আবুল কালাম বলেন, সাধারণত স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওয়ারিশ সনদ বিতরণ করতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তারা পলাতক। এরপর থেকে ওয়ার্ড সচিব সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে এ সনদ বিতরণ করতেন। কিন্তু ২০ দিন ধরে দেখি সব অফিস বন্ধ। কিন্তু কেন বন্ধ বা কবে নাগাদ অফিস চালু হবে কেউ কিছু বলছে না।

চলতি মাসের শুরু থেকে ঢাকায় এডিস মশার উপদ্রব বাড়ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২৪ ঘণ্টার আপডেটে প্রতিদিনই জানানো হচ্ছে হাসপাতালে ভর্তির খবর। সামনের দিনগুলোতে এ মশার উপদ্রব আরও বাড়বে।

অথচ বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের চলমান আন্দোলনের কারণে গত ১৪ মে থেকে ডিএসসিসিতে মশক নিধন কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। নগর ভবনসহ আঞ্চলিক অফিসগুলোতে তালা থাকায় মশার ওষুধও বের করতে পারছেন না সংস্থাটির কর্মচারীরা।

ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, মশার ওষুধ নগর ভবনের নিচ তলাসহ আঞ্চলিক অফিসগুলোতে স্টোররুমে রাখা আছে। কিন্তু আন্দোলনের কারণে কেউ মশার ওষুধ বের করতে পারছেন না। এ কারণে নগরে ক্রমেই এডিস মশার উপদ্রব বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

ওয়াসা ভবনে অফিস করেন ডিএসসিসি প্রশাসক

ইশরাক সমর্থকদের টানা আন্দোলনের কারণে নগর ভবনে ঢুকতে পারছেন না ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া। তিনি ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বেও আছেন। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান বঙ্গবাজার-সংলগ্ন সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের একটি কক্ষে বসে অফিস করেন বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন চুপ থাকার পরিস্থিতি নেই, ইশরাকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত শিগগির রিট খারিজ, ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ পড়াতে বাধা নেই ইশরাকের শপথ: আদালতের রায়ের অপেক্ষায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়

করপোরেশনে না গিয়ে নাগরিক সেবা কীভাবে পরিচালনা করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, তাদের আন্দোলনের কারণে বেশ কিছু নাগরিক সেবা বন্ধ। তবে এর মধ্যে শুনেছি, ডিএসসিসির তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কিছু কর্মচারীকে নিয়ে বিএনপি নেতা (ইশরাক) বৈঠক করেছেন। তাদের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও মশক নিধনে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথকে কেন্দ্র করে চলমান আন্দোলনে দক্ষিণ সিটির নাগরিক সেবা সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে এভাবে নগর ভবন দখল রাষ্ট্রের জন্য ভালো নয়। এ বিষয়ে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ দাবি আদায়ের নামে এভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখল করার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটিতে প্রায় কোটি মানুষ বসবাস করে। প্রতিদিনই তাদের সেবার দরকার হয়। সরকারকে এ সেবা স্বাভাবিক করতে হবে। সামনে এডিস মশার উপদ্রব বাড়া ও জলাবদ্ধতার মতো সমস্যা হতে পারে। এখনই প্রস্তুতি না নিলে নাগরিক ভোগান্তি আরও বাড়বে।

এমএমএ/এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম