• অর্ধেক হিমাগারই বন্ধ, সচলগুলো ব্যক্তিগত দখলে• ফল-সবজি রাখতে পারেন না সাধারণ কৃষকরা• আমের বদলে রাখা হচ্ছে গুড়-বিদেশি ফল • সচল হিমাগার থেকেও নষ্ট হচ্ছে ফল-সবজি
Advertisement
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষক নাসির উদ্দিন। কানসাট বাজারে আম বিক্রি করতে এসেছেন। তবে মুখে হাসি নেই। কারণ আমের দামে তিনি হতাশ। গড়ে প্রতি কেজি ক্ষীরশাপাতি আম বিক্রি করছেন ১৩-১৭ টাকা দরে।
নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার আমে খুব লস হবে। করাণ এবার আম দ্রুত পেকে যাচ্ছে। ফলে এই আম রাখা দায় হবে। না বিক্রি করলে পচে নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু রাখার তো কোনো জায়গা নেই।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে একটি মিনি হিমাগারের উদ্বোধন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কিন্তু সেখানে তো আর আম রাখতে দেওয়া হয় না। সেখানে রাখা হয় গুড়, আপেল, কমলা। যার কাছে এটি দিয়েছি তিনি নিজেই তো এটি ব্যবহার করেন, অন্য কাউকে রাখতে দেন না। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
Advertisement
‘যদি এই আমগুলো হিমাগারে রাখতে পারতাম তবে দ্বিগুণ দাম পেতাম। কিন্তু আমাদের কী আর সেই কপাল আছে! আমের জায়গাতে রাখা হচ্ছে গুড় ও বিদেশি ফল। আমাদের কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না’, বলেন আম ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন।
নাসির উদ্দিনের মতো কৃষকদের কথা মাথায় রেখে রাজশাহী বিভাগে স্থাপন করা হয় ১১টি মিনি হিমাগার। কিন্তু নানা সংকটে সেগুলো অর্ধেকই বন্ধ আছে। আর যে পাঁচটি চালু আছে সেগুলোও ব্যবহার হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন হিসেবে। মানে যার নামে প্রকল্প দেওয়া হয়েছে তিনিই শুধু এটি ব্যবহার করছেন; অন্যদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে বিভাগে মোট ১১টি মিনি হিমাগার স্থাপন করে কৃষি বিভাগ। হিমাগার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় চার কোটি ২৮ লাখ ৬১ হাজার টাকা। এগুলোর প্রথম তিনটি ছিল পাইলট প্রজেক্ট। এরপর আরও আটটি প্রজেক্ট বাড়ানো হয়েছে। এরমধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ ও মিটার-ট্রান্সফরমার চুরির কারণে ছয়টি প্রজেক্ট বন্ধ আছে। বাকি পাঁচটি প্রজেক্ট চালু থকেলেও সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে ব্যক্তিগত হিসেবে। অন্য চাষিদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে প্রান্তিক চাষিরা কম দামেই বিক্রি করে দিচ্ছেন ফসল।
‘সরকারিভাবে একটি মিনি হিমাগারের উদ্বোধন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কিন্তু সেখানে তো আর আম রাখতে দেওয়া হয় না। সেখানে রাখা হয় গুড়, আপেল, কমলা। যার কাছে এটি দিয়েছে তিনি নিজেই তো এটি ব্যবহার করেন, অন্য কাউকে রাখতে দেন না। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
Advertisement
আরও পড়ুন:
হিমাগারে ১ কেজি আলু রাখতে গুনতে হবে ৮ টাকা ‘ব্যবসায়ীদের দখলে’ হিমাগার, ভাড়া কমলেও কমেনি ভোগান্তিসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালে। তবে নানা কারণে পাইলট প্রজেক্টে ভালো ফলাফল আসেনি। এরপর আরও আটটি মিনি হিমাগার স্থাপন করা হয়। তবে এগুলোর অন্তত তিনটি হিমাগারে আম পচে যাওয়া, ড্রাগন ফল নষ্ট হওয়া এবং মিষ্টি কুমড়া নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণ হিসেবে ‘ম্যানেজমেন্ট সমস্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চাঁপাইনাবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে এমনই একটি হিমাগার স্থাপন করা হয়েছে। তবে সেটিতে রাখা হয়েছে পাটালি গুড়, ঝোলা গুড় ও বিদেশি ফল। ইসমাইল খান শামীম নামের এক ব্যক্তি ভরা আমের মৌসুমে আম না রেখে রেখেছেন বিদেশি ফল ও গুড়।
কৃষকদের অভিযোগ, শামীমের জমিতে মিনি হিমাগারটি স্থাপন করা। প্রকল্পটিও তার নামে হওয়ায় তিনি নিজেই এটি ব্যবহার করেন; অন্যদের ব্যবহার করতে দেন না।
স্থানীয় কৃষক এমাজ উদ্দিন দাবি করেন, তিনি রাখতে চাইলেও তাকে রাখতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ শামীম সেখানে গুড় ও আমদানি করা ফল রেখেছেন।
এ বিষয়ে ইসমাইল খান শামীম বলেন, ‘আমি আমার গুড় রেখেছি। কেউ যদি আম রাখতে চাই তাহলে তাকে সুযোগ দেওয়া হবে। তবে কেউ এখনো আম রাখেনি বা রাখতে চায়নি।’
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিবপুরে আলী হোসেনকে দেওয়া হয়েছে একটি মিনি হিমাগার। তবে গত ছয় মাস হলো সেখানে মিটার নেই। মিটার চুরির কারণে সেটি বন্ধ পড়ে আছে। ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, হিমাগারের র্যাকগুলোতে রেখেছেন সার-বিষের কার্টন।
আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি সিঙ্গেল চেম্বার সুতরাং যাই রাখতে হয় এক রকমেরই রাখতে হয়। আগামীতে এখানে বিদ্যুৎ ফিরে পেলে আমি লেবু রাখবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এটি একাই ব্যবহার করি, অন্যরা আগ্রহ দেখায় না। তাই আমিই বিল দেই, আমিই চালাই।’
আরও পড়ুন:
আম সংরক্ষণে ভরসা শফিকুলের ছোট হিমাগার দেশে ১০০ মিনি হিমাগার তৈরি হবে: কৃষি উপদেষ্টাআরও শোচনীয় অবস্থা নাটোরের হিমাগারের। নাটোরের আহমেদপুরে সেলিম রেজা নামের একজন কৃষককে ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পরীক্ষামূলকভাবে একটি মিনি সংরক্ষণাগার নির্মাণ করে দেওয়া হয়। নির্মাণের পর থেকে এই সংরক্ষণাগারে ফল রাখতে গেলে ফল সতেজ থাকে না, পচন ধরে। বর্তমানে মিনি সংরক্ষণাগারটি বন্ধ রয়েছে।
কথা হয় প্রকল্পের পরিচালক এস এম হাসানুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মিনি হিমাগারগুলোর কোনোটিতে আম, কোনোটিতে আপেল-কমলা আবার কোনোটিতে গাজর রাখা হয়েছে। বিভাগে মোট ১১টি হিমাগার স্থাপন করা হয়েছে। এটির একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা এটির ভাড়া নির্ধারণ করে দেবেন।
‘হিমাগারগুলো একার ব্যবহারের জন্য নয়, গ্রুপের সঙ্গে মিটিং করে সবাই রাখতে পারবেন। কৃষকরা যদি রাখতে চান তাহলে তারা দিতে বাধ্য। তাদের সঙ্গে আমাদের এমনই চুক্তি হয়েছে। আমাদের অনুমতি ছাড়া তারা অন্য কাজে হিমাগার ব্যবহার করতে পারবেন না। যদি করেন তাহলে আমার পানিশমেন্ট দেবো।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের ফল-সবজি সারা বছর থাকে না। এজন্য অন্য সময় গুড় বা অন্য কিছু রাখা হয়। বিদ্যুৎ বিল মিনিমাইজ করার জন্যই তারা এগুলো রাখেন।
সবজি-ফল নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গ প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এটি এখনো গবেষণার মধ্যেই রয়েছে। কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে, সেগুলো না মানার কারণে আম বা অন্য কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
কৃষকদের ব্যবহার করতে না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি একার ব্যবহারের জন্য নয়, গ্রুপের সঙ্গে মিটিং করে সবাই রাখতে পারবেন। কৃষকরা যদি রাখতে চান তাহলে তারা দিতে বাধ্য। তাদের সঙ্গে আমাদের এমনই চুক্তি হয়েছে। আমাদের অনুমতি ছাড়া তারা অন্য কাজে হিমাগার ব্যবহার করতে পারবেন না। যদি করেন তাহলে আমার পানিশমেন্ট দেবো।
এসআর/এমএস