মতামত

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্র: দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পরিণতি

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্র: দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পরিণতি

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত এবং ইসরায়েলের আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ইরানের একটি বা একাধিক পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সংবাদ এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন ও সম্প্রতি ইরানের পরমাণু স্থাপনায় সম্ভাব্য হামলার মাধ্যমে সংঘাত এখন এমন এক পথে এগোচ্ছে, যা ভবিষ্যতের ভূরাজনীতিকে আমূল বদলে দিতে পারে।

Advertisement

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে আগেই শত্রুতা বিদ্যমান ছিল, এখন তা সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। ইরান তার প্রক্সি গোষ্ঠি যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাসকে সক্রিয় করেছে। ইসরায়েলও সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিয়েছে এবং আক্রমণাত্মক মোডে প্রবেশ করেছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই যুদ্ধ কি বিজয়ের গল্প হবে, নাকি এক দীর্ঘস্থায়ী “ওয়ার অব এট্রিশন” এর মাধ্যমে কিছু রাষ্ট্র, তাদের ভূখণ্ড, অর্থনীতি ও সভ্যতা ধ্বংস হবে? বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েল ঠিক সেই পথেই হাঁটছে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধটিকে আর একটি সীমিত দ্বন্দ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছে না, বরং এটিকে একটি আঞ্চলিক মহাযুদ্ধে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি করছে।

প্রেক্ষাপট

ইসরায়েল বহু বছর ধরেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে, ইরান মনে করে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে তার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে। গত ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তে ইরান, সিরিয়া ও লেবাননে ইরানি ঘাঁটিতে ইসরায়েলের টার্গেটেড স্ট্রাইক এবং পরে ২২ জুন ২০২৫ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার খবর পরিস্থিতিকে নাটকীয়ভাবে উত্তপ্ত করে তোলে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল হচ্ছে আমেরিকার একটি প্রক্সি দেশ, যার মাধ্যমে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা দখল নেয়ার একটা মহাপরিকল্পনা করেছে। সাথে আছে ইসরায়েলের ‘জায়োনিজম’ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা।

যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ এবং এর প্রভাব

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যেই জাতিসংঘের কোনো অনুমোদন ছাড়াই অনিয়মতান্ত্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন ‘মিডনাইট হ্যামার’এর ব্যানারে গত ২২ জুন ২০২৫ তারিখে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র ফোর্ডো (Fordow), নাতানজ (Natanz) এবং ইসফাহান (Isfahan) এ ব্যয়বহুল বিমান আক্রমণ করেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এই হামলাকে “ব্যাপক সাফল্যময়” এবং “অসাধারণ সফলতা” বলে অভিহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৫০টির বেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যার অনেকগুলো ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন ও কাতারে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইসরায়েলের পাশে অবস্থান নিয়ে ইরানকে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র নয়, বরং হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। 

Advertisement

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে আগেই শত্রুতা বিদ্যমান ছিল, এখন তা সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। ইরান তার প্রক্সি গোষ্ঠি যেমন হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাসকে সক্রিয় করেছে। ইসরায়েলও সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিয়েছে এবং আক্রমণাত্মক মোডে প্রবেশ করেছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই যুদ্ধ কি বিজয়ের গল্প হবে, নাকি এক দীর্ঘস্থায়ী “ওয়ার অব এট্রিশন” এর মাধ্যমে কিছু রাষ্ট্র, তাদের ভূখণ্ড, অর্থনীতি ও সভ্যতা ধ্বংস হবে?

যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা শুধু একটি সামরিক হামলা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ভারসাম্য এবং বৈশ্বিক কূটনীতির জন্য এক চরম উত্তেজনাকর ও বিপজ্জনক মোড়। এই ধরনের একতরফা পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা একটি "point of no return" পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। একে আর স্বাভাবিক কূটনীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এই হামলা বিশ্বকে নিয়ে যেতে পারে এক নতুন ধরনের যুদ্ধ, যার পরিণতি হতে পারে।

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে তিনটি সম্ভাব্য পরিণতি

ইসরায়েলের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাব্য পতন : ইসরায়েলের যে-কোনো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জয়লাভের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কারণ একটাই—কৌশলগত গভীরতার অভাব (Strategic Depth)। ইসরায়েল একটি ছোট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ রাষ্ট্র। একটি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে তার অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে, শহরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তারা পরমাণু হামলা চালিয়ে শেষ মুহূর্তে শত্রুকে ধ্বংসের চেষ্টা করতে পারে। তবে তা কেবল চূড়ান্ত ধ্বংস নিশ্চিত করতে পারে, বিজয় নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে—ইসরায়েলিদের দ্বৈত নাগরিকত্ব। প্রায় সাত লক্ষ ইসরায়েলি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে ইসরায়েল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা বাড়লে এই দ্বৈত নাগরিকেরা পশ্চিমে ফিরে যাবেন এবং আর ফিরবেন না। ফলে জনবলের দিক থেকেও ইসরায়েল দুর্বল হয়ে পড়বে।

ইরানের প্রতিরোধ যুদ্ধ: ইরান শুধু একটি রাষ্ট্র নয়, এটি একটি বিপ্লবের ফসল। ইসলামি বিপ্লবের পর এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর ইরান ৪০ বছর ধরে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো প্রচলিত অস্ত্রে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। জিপিএস বা স্যাটেলাইটেও এসবের অবস্থান নিশ্চিতভাবে ধরা যায় না। একমাত্র উপায় স্থল অভিযান—কিন্তু ইরানের ভৌগোলিক গঠন, পর্বতমালা ও ঘনসংখ্যক প্রতিরোধশক্তি এ অভিযানের জন্য এক দুর্ধর্ষ ফাঁদ।

Advertisement

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও এক সম্ভাব্য ভিয়েতনাম পুনরাবৃত্তি : ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান করে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে সরাসরি আক্রমণ করে, বিশেষ পারমাণবিক স্থাপনায়, তবে ইরান নিশ্চিতভাবে মার্কিন ঘাঁটিগুলিতে হামলা চালাবে  এবং প্রয়োজনে সেটা করবে। এতে ব্যাপক হতাহত ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি এরপর স্থল অভিযান চালায়, তাহলে সেটি ভিয়েতনামের চেয়েও বড় একটি ফাঁদে পড়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে—ইরাক ও আফগানিস্তানে তারা শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করেও কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ইরান সেই অভিজ্ঞতার চেয়েও কঠিন এক প্রতিপক্ষ।

যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরকার সম্ভাব্য সংঘাত : যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধ যদি বড় ধরনের ব্যর্থতায় শেষ হয়, তবে কেবল বৈশ্বিক সামরিক আধিপত্য নয়, তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে। এই ব্যর্থতা তৈরি করতে পারে, যেখানে সাধারণ আমেরিকানরা মনে করবে, তাদের রাষ্ট্রকে ইসরায়েল-সমর্থিত জায়নবাদী লবিগুলো যুদ্ধে ঠেলে দেউলিয়া করে দিয়েছে। এই মনোভাব জায়নবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতা উসকে দিতে পারে, যা জার্মানিতে ইহুদিবিদ্বেষের পথ প্রশস্ত করেছিল। একটি অভ্যন্তরীণ দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে গণমাধ্যম, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে আধিপত্যকারী জায়নবাদী শক্তিকে দায়ী করা হবে।

ইরান ও ইসরায়েলের সম্ভাব্য যুদ্ধকৌশল ও পদক্ষেপ:

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বর্তমানে এক উত্তপ্ত পর্যায়ে অবস্থান করছে। দুই পক্ষই নিজেদের অস্তিত্ব, প্রভাব ও মর্যাদার প্রশ্নে লড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, দুই দেশেরই সামনে কিছু নির্দিষ্ট কৌশল ও সম্ভাব্য পদক্ষেপ রয়েছে—যা তারা তাদের সামরিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় গ্রহণ করতে পারে।

ইরানের সম্ভাব্য পদক্ষেপ ও যুদ্ধকৌশল : ইরান সরাসরি না লড়েও প্রক্সি গ্রুপগুলো ব্যবহার করবে, যেমন- হিজবুল্লাহ (লেবানন) উত্তর ইসরাইলে রকেট হামলা, হামাসের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ, হুথি (ইয়েমেন) ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা ইসরায়েল বা সৌদি লক্ষ্যে হামলা, ইরাক-সিরিয়া মিলিশিয়া মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করবে।  ইসরায়েলের পানি, বিদ্যুৎ, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং সিস্টেমে সাইবার হানা চালাতে পারে। ইরান নিজেও সাইবার প্রতিরক্ষা জোরদার করবে এবং সম্ভাব্য ইসরায়েলি হামলার জবাব দেবে।  হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ আটকানো, ড্রোন হামলা বা মাইন স্থাপন—বিশ্বব্যাপী তেল পরিবহনে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতি ও জ্বালানির বাজারে চাপ সৃষ্টিই লক্ষ্য। ইরান প্যালেস্টাইন ইস্যুকে সামনে রেখে মুসলিম বিশ্বের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, জাতিসংঘ ও ওআইসিতে কূটনৈতিক আক্রমণ জোরদার করবে।

ইসরায়েলের সম্ভাব্য পদক্ষেপ ও যুদ্ধকৌশল : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, মিসাইল ঘাঁটি, প্রক্সি ঘাঁটি লক্ষ্য করে প্রিসিশন স্ট্রাইক করছে এবং করবে। সিরিয়া ও লেবাননে থাকা ইরানি অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করবে। ইসরায়েলের আয়রন ডোম (Iron Dome), ডেভিডস স্লিং, অ্যারো-৩—এইসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে স্কল প্রকার আকাশ  আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। বেসামরিক নাগরিকদের বোমা শেল্টারে সরিয়ে নেওয়া, সীমান্ত এলাকায় জরুরি অবস্থা জারি করবে। ইরানের পরমাণু প্রকল্প, পাওয়ার গ্রিড, ব্যাংকিং ও কমিউনিকেশন সিস্টেমে সাইবার হামলা চালানো হতে পারে। অতীতে যেমন Stuxnet ব্যবহার হয়েছিল, তেমনি উন্নত সাইবার অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স–এইসব দেশের সমর্থন নিশ্চিত করবে। আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করবে—বিশেষ করে সৌদি আরব ও আমিরাতের সঙ্গে গোপন সমন্বয়ের মাধ্যমে।

উভয় পক্ষের একটি যৌথ কৌশলগত সম্ভাবনা: 'Shadow War' বা 'Gray Zone Conflict': এটি একটি পুরোপুরি খোলা যুদ্ধ নয়, বরং নিয়মিত সীমিত হামলা, গুপ্তচরবৃত্তি, সাইবার হামলা ও প্রক্সি যুদ্ধের এক মিশ্র ধারা। উভয় পক্ষ একে অপরকে ক্ষতি করতে চাইবে, তবে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করবে।

সম্ভাব্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিণতি এবং প্রভাব

অর্থনীতি এবং মানবিক সংকট : তেলের দাম বেড়ে যাবে। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি, খাদ্য ও পণ্যের দাম বৃদ্ধি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে ধস নামবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো থেকে শরণার্থী প্রবাহ। খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকট বেড়ে যাবে। মানবিক সহায়তা বিঘ্ন হবে। শিশু ও নারীদের প্রতি সহিংসতা বাড়ার আশঙ্কাসহ তাদের ভয়াবহ মানবিক দুর্ভোগ বাড়বে।

ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন এবং নতুন মেরুকরণ : বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতি ইতোমধ্যেই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা (ইসরায়েল, ইউরোপের কিছু দেশ) একদিকে, এবং চীন-রাশিয়া-ইরান অন্যদিকে অবস্থান করছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এই বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলবে। চীন ও রাশিয়া ইরানকে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিতে পারে, যেমন অস্ত্র, ড্রোন প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ডেটা ইত্যাদি। এতে করে বিশ্ব দ্বিমেরু রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করবে, যেখানে একটি ব্লক হবে পশ্চিমা শক্তিশালী দেশগুলোর নেতৃত্বে এবং অপরটি চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে। বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিভক্তি আরও প্রকট হবে। জাতিসংঘ কার্যত পক্ষপাতদুষ্ট ও অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।

তৃতীয় পক্ষীয় সংঘাত বৃদ্ধি : তুরস্ক, সৌদি আরব, পাকিস্তান, কাতার নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে ব্যস্ত হবে বলে অনুমেয়। মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একটি জটিল ধর্মীয়, সামরিক ও ভূরাজনৈতিক চাপের মুখে পড়বে। এ অঞ্চলে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা চুক্তি, ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং বাড়বে। অনেক দেশ নিজস্ব পরমাণু কর্মসূচি গোপনে বা প্রকাশ্যে উন্নয়নের চিন্তা করতে পারে। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রাজনীতি তীব্রতর হবে। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন—এই অঞ্চলগুলোতে ইরানের প্রভাবিত মিলিশিয়া (যেমন: হিজবুল্লাহ, হাশদ আল-শাবি) যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরব ও ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা বাড়াতে পারে। সৌদি আরব, কাতার, ওমান—এই দেশগুলো যুদ্ধের প্রভাব ও চাপে পড়ে কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যবস্থার ওপর আস্থার সংকট : জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মতো বড় সংকটে যদি জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারে, তবে বিশ্বব্যাপী এর ওপর আস্থা আরও কমে যাবে। মানবিক সহায়তা, যুদ্ধবিরতি, যুদ্ধাপরাধ তদন্ত— এই সবগুলোতেই জাতিসংঘ ব্যর্থ হলে নতুন শক্তির উদ্ভব হতে পারে, যেমন     ; চীন বা মুসলিম দেশগুলোর নিজস্ব জোট। আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা কমে যাবে। "Power is right" বা শক্তিই ন্যায়—এই বাস্তবতায় প্রবেশ করবে বিশ্ব যা কিনা মানবিক জীবনকে অস্থির করবে। ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিরাপত্তায় চরম ঝুঁকিতে পড়বে।

তেল সরবরাহ ও জ্বালানি সংকট: ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তবে বিশ্বের ২০% তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম উর্ধ্বমুখী, খাদ্যদ্রব্য ও পণ্য পরিবহনে বিপর্যয় এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো চরম জ্বালানি সংকটে পড়তে পারে।

ইসরায়েলের অস্তিত্বমূলক সংকট: দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ইসরায়েলের অর্থনীতি, সেনাবাহিনী ও জনমনে ক্লান্তি সৃষ্টি করবে। হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য গোষ্ঠীর লাগাতার হামলা উত্তর ইসরায়েলকে প্রায় বসবাসের অনুপযোগী করে তুলতে পারে। এই যুদ্ধ ইসরায়েলের জনগণের উপর দারুণ মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে যা একসময় ভিন্ন মাত্রার বিশৃঙ্খলায় রূপ নিতে পারে।

চীন ও রাশিয়ার ভূমিকায় উত্তেজনা বৃদ্ধি: চীন ও রাশিয়া এই হামলাকে আগ্রাসন হিসেবে নিন্দা করে কৌশলগত সমর্থন দিতে পারে ইরানকে। এটি যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন-রাশিয়া মেরুকরণকে নতুনমাত্রা দেবে এবং নতুন ধরনের ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হতে পারে।

ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা জটিল হয়ে উঠতে পারে: যুদ্ধের ধাক্কায় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে, অর্থনৈতিক চাপ তীব্র হবে। এটি ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, আবার জাতীয়তাবাদী উগ্র শক্তিও ক্ষমতায় উঠতে পারে।

সাইবার যুদ্ধ ও প্রযুক্তি অবকাঠামো বিপর্যয়: ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সাইবার আক্রমণ চালাতে পারে, যার ফলে বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকবে। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্কেও হানা পড়তে পারে।

আঞ্চলিক যুদ্ধের বিস্তার ও সমীকরণ: উভয় দেশের জন্য এই যুদ্ধ এখন একটি অস্তিত্বের লড়াই। এটি কেবল ইরান-ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ থাকবে না, বরং একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হবে—যার কেন্দ্রে থাকবে মধ্যপ্রাচ্য। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার—এইসব দেশ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমর্থন চাইবে, যা আরও দেশকে যুদ্ধে টেনে আনবে। এই যুদ্ধ এখন অনেক সমীকরণ তৈরি করতে পারে, অনেক সমীকরণ বদলে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, যদি রাশিয়া ও চীন পরোক্ষভাবে ইরানকে সমর্থন করে।

বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রসারের ঝুঁকি: ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির গতি দ্রুততর করতে পারে "আত্মরক্ষা"র যুক্তিতে। এর ফলে সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর—তাঁরাও পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্ব ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কা থাকবে।

পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা: যদি পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায়, তাহলে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিতে পারে। এটি মানব সভ্যতার জন্য ভয়ংকর নজির স্থাপন করবে এবং জাতিসংঘের অস্তিত্বগত প্রশ্ন তুলবে। এই সুযোগে আন্তঃদেশীয় পারমাণবিক প্রযুক্তি বিস্তার বেড়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ওপর প্রভাব: খাদ্য, তেল ও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে, যা বাংলাদেশসহ বহু দেশের মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনবে। প্রবাসী শ্রমিক ও রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাহত হতে পারে।

করণীয়:

শান্তির উদ্যোগ: জাতিসংঘ ও নিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে (যেমন: তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া) মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ওআইসি, গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (GCC), ও আরব লীগকে এগিয়ে আসতে হবে মধ্যস্থতায়। যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী বলয়ে থাকা শক্তিগুলোর মাধ্যমে ইরানকে কৌশলগতভাবে সংযত রাখার দ্রুত চেষ্টা করতে হবে । যুদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলোর জন্য UNHCR, ICRC ও WHO এর মাধ্যমে মানবিক সাহায্যের প্রস্তুতি জোরদার করা। গাজায় ইসরায়েলের হামলা বন্ধ এই এলাকায় একটা শান্তির প্রভাব পড়তে পারে।

ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই এলাকায় অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রকে ভীতি প্রদর্শন, আক্রমণ এবং ঘৃণা প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে। যুগ যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং ইউরোপীয় কিছু রাষ্ট্র কর্তৃক মুসলিমদের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী’ উপাধি দিয়ে যুদ্ধ বিস্তার এবং ব্যবসায়িক ফায়দা লুটা বন্ধ  করতে হবে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যদি পূর্ণমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্র এতে সরাসরি অংশ নেয়, তাহলে এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথ আমূল পাল্টে দিতে পারে। সময়মতো কূটনৈতিক ও মানবিক পদক্ষেপ না নিলে এই সংঘাত পরিণত হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাসে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করণীয়: তেল সরবরাহের বিকল্প উৎস খোঁজা ও জ্বালানি মজুত বাড়াতে হবে। প্রবাসীদের নিরাপত্তা জোরদার ও শ্রমবাজারের সম্ভাব্য সংকটে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও যুক্তরাষ্ট্র-ইরান উভয়ের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার ব্যাপারে কাজ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এখন আর মধ্যপ্রাচ্যের সীমিত সংঘাত নয়, বরং এটি এক ধীরে ধীরে প্রসারমান বৈশ্বিক নিরাপত্তা সংকট। যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জড়িত হওয়া এ সংকটকে আরও গভীর ও জটিল করে তুলেছে। যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ততই মানবতা, অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থার ওপর তার প্রভাব ভয়াবহ হয়ে উঠবে। যুদ্ধ যদি সত্যিই ওয়ার অব এট্রিশনে রূপ নেয় তাহলে এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী, বহুমাত্রিক বৈশ্বিক সংকটের জন্ম দেবে। এটি শুধু সামরিক যুদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, কূটনৈতিক ও মানবিক সংকটের যুগ ডেকে আনতে পারে। তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে এই যুদ্ধ থামানো এবং টেকসই সমাধান খোঁজা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।

এইচআর/জিকেএস