ফিচার

প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা নেত্রকোনা

হুমায়ুন আহমেদ নাইম

ময়মনসিংহ বিভাগের এক অনিন্দ্য সুন্দর জেলা নেত্রকোনা, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত। ভারতের মেঘালয় সীমান্তের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এই জেলায় রয়েছে প্রকৃতির অপরূপ শোভা-গারো পাহাড়ের হাতছানি, পাহাড়ি জলপ্রপাত, চীনা মাটির মনজুড়ানো দৃশ্য, সুবিশাল হাওর, আর অসংখ্য ছোট-বড় বিল।

খনিজ সম্পদে ভরপুর এই জেলা কাঁচ বালি, সিলেকশন বালি, কয়লা, কেউলিন এবং পাথরের জন্যেও সুপরিচিত। প্রায় ২,৮১০.২৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই জেলাটি ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি এটি পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা লাভ করে।

নেত্রকোনার উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা অবস্থিত। এই জেলার প্রতিটি উপজেলাতেই ছড়িয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক আকর্ষণ। আসুন নেত্রকোনার কিছু সুন্দর স্থান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-

দুর্গাপুরচিনামাটির পাহাড় আর সোমেশ্বরীর নীল জল নেত্রকোনার পর্যটন মানচিত্রে দুর্গাপুর নিঃসন্দেহে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। মেঘালয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত এই উপজেলা প্রকৃতির এক অসাধারণ চিত্রপট এঁকেছে।

বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড় ও নীল হ্রদদুর্গাপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হলো বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড়, যা স্থানীয়ভাবে সাদা মাটির পাহাড় নামে পরিচিত। এখানকার সাদা মাটির টিলা আর তার পাশে নীলচে-সবুজ জলের হ্রদ এক পরাবাস্তব দৃশ্য তৈরি করে। স্বচ্ছ জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি আর সবুজের সমারোহ যেন কোনো শিল্পীর আঁকা ছবি। এই দৃশ্য এতটাই মন মুগ্ধকর যে মনে হবে আপনি কোনো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

সোমেশ্বরী নদীভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদী দুর্গাপুরের প্রাণ। বর্ষাকালে এর স্বচ্ছ ও নীল জলধারা পর্যটকদের মুগ্ধ করে। নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে চলা বা নৌকায় ঘুরে বেড়ানো এক দারুণ অভিজ্ঞতা হতে পারে আপনার জন্য।

উপজাতীয় কালচারাল একাডেমিদুর্গাপুর গারো, হাজং, কোচসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনধারা সম্পর্কে জানতে ঘুরে আসতে পারেন উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি থেকে। এখানে আদিবাসী হস্তশিল্প, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র এবং তাদের লোকাচার সম্পর্কে একটি দারুণ ধারণা পাবেন।

ঐতিহাসিক নিদর্শনএই উপজেলায় আরও আছে কমলা রাণী দিঘী, টংক আন্দোলনের নেত্রী রানীমাতা রাশমণি স্মৃতিসৌধ, টংক শহীদ স্মৃতিসৌধ, রানীখং মিশন, কুমুদিনী স্তম্ভ এবং কমরেড মণি সিংহ রায় এর বাড়ি ও স্মৃতিস্তম্ভ, যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কলমাকান্দা: সীমান্ত পাহাড়ের মায়াবী হাতছানিভারতের মেঘালয় সীমান্তের কোল ঘেঁষে থাকা কলমাকান্দা উপজেলা তার পাহাড়ি সৌন্দর্য এবং নির্মল প্রকৃতির জন্য পরিচিত।

চন্দ্রডিঙা পাহাড়সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত চন্দ্রডিঙা পাহাড় একটি মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ গন্তব্য। এখানে পাহাড়ের চূড়া থেকে চারপাশের মনোরম দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।

পাঁচগাঁওকলমাকান্দার রংছাতি ইউনিয়নে অবস্থিত পাঁচগাঁও একটি পাহাড়ি গ্রাম। এখানে প্রবেশ করলে মনে হবে যেন এক টুকরো মেঘালয় এসে মিশেছে বাংলাদেশের মাটিতে। এখানকার শান্ত পরিবেশ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনকে সতেজ করে তোলে।

সাত শহীদের মাজার১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে নির্মিত সাত শহীদের মাজার ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।

হাওর অঞ্চলের মোহনীয় রূপ: মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ি ও মদননেত্রকোনার বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর, যা বর্ষাকালে এক ভিন্নরূপ ধারণ করে। মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ি ও মদন উপজেলা এই হাওর অঞ্চলের প্রধান আকর্ষণ।

ডিঙাপোতা হাওর (মোহনগঞ্জ)বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওরগুলোর মধ্যে অন্যতম ডিঙাপোতা হাওর বর্ষায় অথৈ জলে ভরে যায়। তখন চারদিকে শুধু জলরাশি আর মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো জেগে থাকা গ্রামগুলো এক অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করে। নৌকায় হাওর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আপনার জন্য অবিস্মরণীয় হতে পারে।

খালিয়াজুড়ি হাওর ও উচিতপুর হাওর (মদন)মোহনগঞ্জের মতো খালিয়াজুড়ি ও মদন উপজেলার খালিয়াজুড়ি হাওর এবং উচিতপুর হাওরও বর্ষায় তার রূপ মেলে ধরে। এই সময় হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।

নেত্রকোনা সদরএখানে রয়েছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র কবিতাকুঞ্জ এবং আধ্যাত্মিক শান্তির প্রতীক হযরত শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী এর মাজার ও আলী হোসেন শাহ এর মাজার। এছাড়াও নেত্রকোনা সদরের অন্যতম আকর্ষণ নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়, যা নেত্রকোনার সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

কেন্দুয়াএখানকার রোয়াইলবাড়ি দুর্গ একটি প্রাচীন দুর্গ যা প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বহন করে। এছাড়াও আছে নলিনী রঞ্জন সরকার এর বাড়ি, যা জমিদারী স্থাপত্যের নিদর্শন।

পূর্বধলাএই উপজেলায় রয়েছে পুরোনো জমিদার বাড়ি, যেমন বাঘবেড় জমিদার বাড়ি এবং নারায়ণডহর জমিদার বাড়ি, যা এই অঞ্চলের অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।

বারহাট্টাজ্ঞান ও সংস্কৃতির চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে রামসুন্দর পাঠাগার এবং বীণাপানি সংগ্রহশালা।

নেত্রকোনা শুধু প্রকৃতির রূপেই নয়, বরং তার ইতিহাস, সংস্কৃতি আর সরল জীবনধারায় দিয়েও আপনাকে মুগ্ধ করবে। তাই আপনি যদি একজন ভ্রমণপিপাসু হন, তাহলে নেত্রকোনা জেলা হতে পারে আপনার জন্য একটি আদর্শ পর্যটন স্থান। নেত্রকোনার শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতি আর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আপনাকে এক ভিন্ন মাত্রার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দেবে। ঢাকা থেকে ১৬০ কিলোমিটার সড়ক দূরত্বে অবস্থিত নেত্রকোনায় সড়কপথ ছাড়াও আন্তঃনগর ও লোকাল ট্রেন যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে।

আরও পড়ুন নির্যাতনের শিকার প্রবীণরা: সমাজের দায়, পরিবারের ভূমিকা  শিশুশ্রম কি দারিদ্র্যেরই ফসল? 

লেখক: ফিচার লেখক

কেএসকে/জিকেএস