যথাযথ বাজার তদারকি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, কৃত্রিম সংকট, নিম্নমানের পণ্য, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তাহীনতা, পণ্য আমদানি প্রক্রিয়ার জটিলতা ইত্যাদি কারণে স্থানীয় বাজারের ভোক্তারা সমস্যার মুখে পড়ছেন। এছাড়াও স্টোরেজ সুবিধার অপ্রতুলতা এবং পণ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতার স্বল্পতার কারণে ভোক্তাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বলে ডিসিসিআই আয়োজিত মতবিনিময় সভা ও অংশীজন সংলাপে মত প্রকাশ করেন অংশগ্রহণকারী আলোচকরা।
শনিবার (১৯ জুলাই) ডিসিসিআই মিলনায়তনে এই মতবিনিময় সভা ও অংশীজন সংলাপ আয়োজিত হয়। এতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শোয়েব, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. মোঃ আখতারুজ্জামান তালুকদার এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ‘কার্যকর বাজার তদারকির মাধ্যমে ভোক্তা ও ব্যবসায়ের স্বার্থ সুরক্ষা’ বিষয়ক এই অংশীজন সংলাপের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্রমাগত সম্প্রসারিত হলেও বাজারে পণ্যের মূল্য কারসাজি, কৃত্রিম সংকট, নিম্নমানের পণ্য, জটিল নিয়মনীতি এবং নানাবিধ হয়রানির কারণে ভোক্তাসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়িত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ফলে ভোক্তাদের আস্থা কমে যাচ্ছে এবং সৎ ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি বাজার তদারকির সমন্বিত কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহিতাপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গঠনের ওপর জোর দেন।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, মধ্যস্বত্তভোগীদের কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যায় এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারী সংস্থাসমূহের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বাজার তদারকির বিষয়টি অতীব জরুরি হলেও, জনবলের অভাবের কারণে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৯টিতেই ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কোনো কার্যালয় নেই। ফলে কার্যকর বাজার তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারণের পরিবর্তে তা চাহিদ ও যোগানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া সমীচীন।
ভোক্তা অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশের মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধি ও বৈসাদৃশ্য পরিহার একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, পণ্য পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্তভোগীদের কারণে বাজারে, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বল্প সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য বৃহৎ বেসরকারি খাতের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাই এ অসাধু ব্যবসায়ীদের রোধে সব স্তরের সৎ ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সমন্বিতভাবে কাজ করার মাধ্যমে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবেই অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তবে সমন্বিতভাবে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি কাজে লাগানো সম্ভব হলে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, বাজারে একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকা কেবল ভোক্তাই নয়, ব্যবসায়ীদের জন্যও সুফল বয়ে আনবে। পণ্য সরবরাহ সংশ্লিষ্ট পর্যাপ্ত তথ্যপ্রাপ্তি ও গবেষণা বাজারে অসম প্রতিযোগিতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
এ মতবিনিময় সভায় মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ গোলাম মওলা, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি খন্দকার মনির আহমেদ, চিনি ও তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আবুল হাসেম, বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন এবং ডিপার্টমেন্ট অব পেটেন্টস, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্কস এর উপ-পরিচালক মির্জা গোলাম সারওয়ার প্রমুখ অংশ নেন।
হাজী মোহাম্মদ গোলাম মওলা বলেন, দেশে সরকারি চিনিকল ১৮টি থাকলেও, এগুলোর বেশিরভাগই এখন কার্যকর নয়। এছাড়াও ভোজ্যতেল রিফাইনারির সংখ্যা ক্রামন্বয়ে কমছে। ফলে কিছুসংখ্যক আমদানিকারকের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় আমদানিনির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে অসম প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পাইকারী থেকে খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রিতে অতি মুনাফা রোধকল্পে খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রির মুনাফার হার নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে তিনি প্রস্তাব করেন।
খন্দকার মনির আহমেদ বলেন, ডিমের চাহিদা বছরের সবসময় একই রকম থাকে না। তাই ডিম সংরক্ষণে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণাগার স্থাপন করা গেলে এ খাতের উদ্যোক্তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবে।
তিনি জানান, দেশের পোলট্রি খাতে বর্তমানে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে, যেখানে প্রায় ৬০ লাখ লোক কর্মরত। এ অবস্থায় বৃহৎ এ শিল্পখাতকে সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কাজী মোহাম্মদ বশির উদ্দিন এ সময় বলেন, বাজার তদারকির কার্যক্রম চলছে, তবে তা গোছানো নয়। ডলারের সংকটের কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খোলার জটিলতার কারণে আমদানি নির্ভর নিত্যপণ্যের সংকটে বাজার পণ্যের মূল্য বাড়ছে।
এছাড়াও মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই পরিচালক মোহাম্মদ জমশের আলী, এনামুল হক পাটোয়ারী এবং প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুস সালাম প্রমুখ অংশ নেন।
ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এএমএ/জেআইএম