জাতীয়

ট্রমা কাটাতে শিশুদের কাছে কিছু গোপন করা যাবে না

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন সব বয়সী মানুষ। ঘটনাটি স্কুলে ঘটায় অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ট্রমাটাইজড। আবার সন্তানহারা বাবা-মায়ের আহাজারি দেখে কাঁদছেন অন্য বাবা-মায়েরাও। রাইসা-সামিয়া-নাফিদের জায়গায় নিজের সন্তানও থাকতে পারতো—ভেবে আঁতকে উঠছেন তারা। বয়স্কদের চেয়ে বেশি ট্রমায় ভুগছে শিশুরা। অনেক অভিভাবক জানাচ্ছেন, তাদের শিশুসন্তান খেতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না। কেউ কেউ আবার মন খারাপ করে বসে থাকছে, কেউবা কাঁদছে। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরাতে নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিষয়ে দীর্ঘদিন পরামর্শ দিয়ে আসছেন অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি সাবেক বিভাগীয় প্রধান, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগ। বিমান বিধ্বস্তের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর শিশুমনে কী ঘটতে পারে, আর করণীয় কী সে বিষয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিশুদের ট্রমায় ভোগার তথ্য জানাচ্ছেন অভিভাবকরা। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করা হলে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বড় ধরনের দুর্ঘটনা, দুর্যোগ, দুর্বিপাকের পর সবার মধ্যে ট্রমা হবে। এখন মুহূর্তেই ঘটনার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তা সবাই দেখেন। ফলে ট্রমা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। শুধু মাইলস্টোন বা আশপাশের শিক্ষার্থীরা নয়, সারাদেশের শিশু-কিশোররা মেন্টালি শকড। যারা টেলিভিশনে দেখেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছে, রেডিও বা অন্য মাধ্যমে শুনেছে বা জেনেছে- সবার মধ্যে ট্রমা কাজ করছে।’

কনটেন্ট ক্রিয়েটররা ভিউ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্ট বানায়। তা শিশুদের দেখানো উচিত হবে না। তারা যত বীভৎসতা দেখবে, তাদের মধ্যে ট্রমা বাড়বে

‘আমরা দেখলাম, ঘটনার পর সেখান থেকে পুড়ে যাওয়া মরদেহ বের করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা কেউ ক্লাস নাইন-টেনে পড়ে, কেউ হয়তো ইন্টারমিডিয়েট। তারাও তো শিশু-কিশোর। তারাই দেখেছে, উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে, চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। আবার সংবাদকর্মী যারা একের পর এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনছেন, লিখছেন বা বলছেন তারাও এ সমস্যায় ভুগতে পারেন। সেটা শুনে বা পড়ে আবার দর্শক-শ্রোতা-পাঠকও ট্রমাটাইজড হচ্ছেন। ফলে এগুলো ছড়ানোর ক্ষেত্রে সবাইকে এথিকস মানতে হবে, বুঝতে হবে যে কতটুকু আমরা দেখাবো বা জানাবো।’

কী কী লক্ষণ দেখা যেতে পারে

শিশুরা বেশি ট্রমায় ভুগছে বা ভুগতে পারে উল্লেখ করে ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু ঘটনাটা স্কুলে ঘটেছে, আমাদের বিশেষ দৃষ্টিটাও শিশুদের জন্য, কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য থাকা উচিত। তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যেমন—তাদের ঘুমের সমস্যা হবে। ওই স্মৃতিটা ভেসে উঠবে। তখন তারা খেতে চাইবে না। ঘরে থেকে বের হতে ভয় পাবে। পড়ালেখা, খেলাধুলা, স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে চাইবে। হাসি-গল্পে মেতে উঠতে চাইবে না। অর্থাৎ, তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে।’

আরও পড়ুন বাচ্চাদের ট্রমা কাটাতে পছন্দসই কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে ‘মেয়ের পর ছেলেও চলে গেলো, আমি এখন কী নিয়ে বাঁচবো’ ‘আমরা টিচার, রাজনীতিবিদ নই’: লাশ গুম ইস্যুতে মাইলস্টোনের শিক্ষক মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: প্রস্তুতির শূন্যতায় হারালাম শিশুর হাসি

‘যেগুলো বললাম, এগুলো একেবারে প্রাথমিক বা তৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘমেয়াদেও তারা সমস্যায় পড়তে পারে। শুধু শিশুরা নয়, বাবা-মায়েরাও দীর্ঘমেয়াদে ট্রমাটাইজড হতে পারে। এটাকে মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা বলি পোস্ট-ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)। এ ডিজঅর্ডারে শিশুরা ভুগতে পারে, বাবা-মাও ভুগতে পারে। সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে বা ঘরে রেখেও বাবা-মা ট্রমায় ভুগতে পারেন।’

ট্রমা কাটাতে করণীয় কী

বড় দুর্ঘটনার পর ট্রমা হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে ট্রমা কাটাতে শিশুসন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের কিছু করণীয় রয়েছে, যা দ্রুত সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

তোমার বন্ধু মারা যায়নি, তোমার বন্ধু বা ভাই-বোন বেঁচে আছে, একটু পরই চলে আসবে…এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস দেওয়াটাও ঠিক হবে না। একটা সময় সে প্রকৃত সত্যটা জানবে, তখন সে আরও মারাত্মক শকড হবে

তিনি বলেন, ‘সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম যেটাকে আমরা বলি, সেই গুণগত সময় দিতে হবে। সেটা ঘরে বসেও হতে পারে, পার্কে নিয়ে যাওয়া বা শিশুর পছন্দের কোথাও নেওয়া। সেই পুরো সময়টাতে বাবা-মাকে মোবাইলফোন বা নিজেদের কাজ এড়িয়ে মনোযোগটা সন্তানের দিকে দেওয়াটা কার্যকর সমাধান হতে পারে। ঘরে খেলাধুলা করলেও তাদের পাশে থাকাটা জরুরি।’

বীভৎসতা থেকে দূরে রাখুন, ভিডিও-ছবি-কনটেন্ট দেখাবেন না

অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, বিমান বিধ্বস্তের সময়কার ও পরবর্তী বীভৎস সব ভিডিও-ছবি শিশুদের দেখানো যাবে না। বাবা-মায়েরও এসব দেখা ও শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে। এখন কনটেন্ট ক্রিয়েটররা ভিউ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্ট বানায়। তা শিশুদের দেখানো উচিত হবে না। তারা যত বীভৎসতা দেখবে, তাদের মধ্যে ট্রমা তত বাড়বে। সুতরাং, বীভৎস দৃশ্য তাদের দেখানো উচিত হবে না। তাদের ঘটনার বর্ণনা শোনানোও ঠিক হবে না। আবার এটা দেখে তাদের অনুভূতি কেমন—তা জানতে চাওয়ার চেষ্টা ভুলেও করা যাবে না।’

তথ্য গোপন না করে শিশুকে সত্যটা বলুন

ট্রমায় ভোগা শিশুর সঙ্গে সব সময় সত্য গল্পটা করা উচিত বলে মনে করেন মনোরোগবিদ ডা. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘শিশুদের সঙ্গে আমরা বড় দুর্ঘটনা বা বীভৎসতা ঘটলে সত্য এড়িয়ে চলি। এটা করা মোটেও উচিত নয়। তাদের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে রাখুন, ভিডিও-ছবি দেখতে দেবেন না। কিন্তু তাই বলে ঘটনার মিথ্যা বর্ণনা বা পরিচিতজনের খারাপ সংবাদ এড়িয়ে চলার প্রয়োজন নেই।’ মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেন এ মনোরোগবিদ। তার ভাষ্য, ‘তোমার বন্ধু মারা যায়নি, তোমার বন্ধু বা ভাই-বোন বেঁচে আছে, একটু পরই চলে আসবে…এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস দেওয়াটাও ঠিক হবে না। একটা সময় সে প্রকৃত সত্যটা জানবে, তখন সে আরও মারাত্মক শকড হবে।’

ধমক দেওয়া থেকে বিরত থাকুন, পড়ালেখায় জোরাজুরিও নয়

ট্রমায় ভোগা শিশুদের ধমক দিলে বা ভয় দেখিয়ে কাজ অথবা পড়ালেখা করাতে চাইলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করেন ডা. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘শিশুদের ধমক দেওয়া যাবে না। পড়ালেখা বা কোনো কাজ করাতে জোরাজুরি করাটাও উচিত হবে না। যেমন—জোর করে বলা তুমি ঘুমাও, তোমাকে স্কুলে যেতেই হবে, তোমাকে পড়তেই হবে। কিংবা তোমাকে আজকের এ হোমওয়ার্কটুকু শেষ করতেই হবে। এগুলো বলা যাবে না।’ মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘সন্তানকে এটাও বলা যাবে না যে, তোমার স্কুলে তো এটা ঘটেনি, তুমি তো আহত হওনি, তুমি তো মারা যাওনি, তোমাকে তো পড়তেই হবে, তোমার তো পরীক্ষা দিতেই হবে, তোমার বন্ধু তো মারা যায়নি, তোমার ভাইয়ের তো কিছু হয়নি—এ ধরনের কথাগুলো বাচ্চাদের সঙ্গে বলা যাবে না। তাদের সঙ্গে গুণগত সময় ও তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে হবে। তারা যাতে পড়ে, খেলাধুলা করে, খেলাধুলা দেখে, বন্ধুদের সঙ্গে উল্লাস করে বেড়াতে পারে বা টিভিতে পছন্দের প্রোগ্রাম দেখে—সেই স্বাধীনতা দিতে হবে।’

হতাহত শিশু-পরিবারকে সহযোগিতা করতে দিতে হবে

ট্রমায় ভোগা শিশুদের হতাহত শিশু বা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করানো বা তাদের সেবা করার সুযোগ দেওয়াটাও ভালো পদক্ষেপ হতে পারে বলে জানান ডা. হেলাল। তার পরামর্শ, ‘হতাহত পরিবার ও শিশুদের সাহায্য করার কোনো সুযোগ যদি থাকে, সেখানে সন্তানদের কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন—আর্থিক সহযোগিতা, অথবা তাদের জন্য দোয়া করা, প্রার্থনা করার বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। সম্ভব হলে পাশে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ানো, সেবা করার সুযোগ যদি তারা কোনোভাবে পায়, সেটাও কিন্তু তাদেরকে মানসিকভাবে ভালো রাখবে। সেটি শিশুরা সুযোগমতো করতে পারে।’ এএএইচ/এএসএ/এএসএম