তার কাছে আইসিইউ শুধু চিকিৎসা দেওয়ার একটি ইউনিট নয়, যেন তার আরেকটি সন্তান। পরিবার যেমন মায়া দিয়ে গড়ে তোলা হয়, তেমনি তিনি এই আইসিইউ গড়ে তুলেছেন ধৈর্য, ত্যাগ আর স্বপ্ন নিয়ে। তাইতো তার সন্তানেরাও বলেন, আইসিইউ তাদের আরেক ভাই।
কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও আইসিইউ প্রধান ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ শূন্য থেকে সেরা অবস্থানে রাজশাহীর এই আইসিইউ।
২০১০ সালে ঢাকা থেকে যখন তিনি রাজশাহীতে ফেরেন, তখন এখানকার আইসিইউয়ের অবস্থা করুণ। জনবল নেই, আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। চারদিকে শুধু শঙ্কা আর ভীতি। তখন কুড়িয়ে কুড়িয়ে যস্ত্রপাতি জোগাড় করলেও সেটি চালু করা যাচ্ছিল না।
তিনি বলেন, যখন আসি, দেখি শুধু জায়গা আছে আর কিছু নেই। মানুষের ভয় ছিল আইসিইউ চালু হলে মানুষ মরবে, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে সমস্যা হবে। সবাই বিরক্ত করবে। কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি। সবাইকে বলেছিলাম কেউ দরজা ভাঙবে না, কাউকে ফোন করে বিরক্ত করবে না। এরপর আস্তে আস্তে শুরু করি। কোথায় কী পড়ে আছে, কোন জায়গায় কী আছে দেখে সব একত্রিত করে দুইটি বেড দিয়ে চিকিৎসা শুরু করি। এরপর প্রথম মাসে আনেক রোগীর সাফল্য পাওয়ার পর এখানকার সবাই আশ্বস্ত হয়। এভাবেই শুরু হয় যাত্রা। এরপর ধাপে ধাপে দেশের সেরা একটি আইসিইউতে পরিণত হয়েছে।
ডা. আবু হেনা বলেন, বেশ কয়েকবার আমি বিদেশে আইসিইউয়ের ওপর প্রশিক্ষণ ও কোর্স করার সুযোগ পেয়েছি। বিদেশ ভ্রমণে যেতাম ঘুরতে নয়, শিখতে। থাইল্যান্ডের আইসিইউ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, ইউরোপে গিয়ে দেখলাম আরও উন্নত সিস্টেম। সেখান থেকেই মনে হয়েছিল আমাদের দেশেও এমনটা সম্ভব।
আবু হেনার স্বপ্নের আইসিইউ এখন শুধু রোগীর জীবন বাঁচায় না, তাদের সম্মানও রক্ষা করে। এখানে মেয়েদের জন্য আছে আলাদা প্রার্থনা কক্ষ, লাইব্রেরি, উন্নত খাবারের ক্যানটিন, যেখানে পরিবারের সদস্যরাও অল্প খরচে মানসম্মত খাবার পান।
ডা. আবু হেনা বলেন, মানুষ হাসপাতালে বসে ফোনে সময় নষ্ট করে। তাই বই পড়ার ব্যবস্থা করেছি। খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি যেন পরিবারের মানুষদের কষ্ট না হয়।
রোগীরা যেন ওষুধ নিয়ে হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য কম দামে ওষুধ সরবরাহের উদ্যোগ নেন। প্রথমে ওষুধ ব্যবসায়ীরা বাধা দিলেও পরে বুঝেছে।
তিনি বলেন, তাদের বলেছি আপনারা রাজশাহী মেডিকেল কলেজেই ব্যবসা করুন, আমাদের এখানে আসবেন না। রোগীরা যেন শোষিত না হয়, সেটাই চাই।
নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করেন এই চিকিৎসক। তার কথায়, ‘আমার কোনো অভাব নেই। সুখী মানুষ দেখতে চাইলে আমাকে দেখো। আল্লাহর কাছে যা চাই, তিনি দেন।’
আরও পড়ুন- রামেক হাসপাতালের গেটে হাঁটুপানি, ভোগান্তিতে রোগী-স্বজনরা রামেকে রোগীর চাপ, অলস পড়ে আছে শিশু হাসপাতাল প্রসূতির পেট থেকে বের করা হলো একে একে পাঁচ ছেলেসবচেয়ে বড় কথা তিনি নিজের সন্তানদের মতো এই আইসিইউকে আগলে রাখেন। বলেন, আমার আরেকটা সন্তান হলো এই আইসিইউ। আমার পরিবার আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়েছে, আমিও তাদের সাপোর্ট দিই। পরিবারের মতো এখানে যা যা লাগে আমি সব করি। নিজের খরচেও করি। এজন্য পরিবারকেও কম সময় দিতে পারি। তাইতো আমার পরিবারের সন্তানরা বলে, আইসিইউ তাদের আরেক ভাই।
তার চোখে একটাই স্বপ্ন, মানুষের হয়রানি কমানো। সেবাকে আরও সহজলভ্য করা। তিনি মনে করেন, সেবা করার সুযোগ সবার ভাগ্যে হয় না। আল্লাহ তাকে সেই সুযোগ দিয়েছেন, তিনি তা কাজে লাগাচ্ছেন। রাজশাহীর এই চিকিৎসক প্রমাণ করেছেন কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়, যদি তা বাস্তবায়নের সাহস থাকে। আর মানুষের সেবা করার মতো সৌভাগ্যও সবার হয় না।
এদিকে আইসিইউতে রোগীর স্বজনদের জন্য উন্নত মানের সুলভ খাবারের ব্যবস্থাই শুধু করেননি তিনি, খাবার পরিবেশনে নজরদারি করতে নিযুক্ত করেছেন আলাদা নার্স। এছাড়াও এখানে রয়েছে যাকাত ফান্ড। অনেক গরিব রোগী এখান থেকে ফ্রিতে চিকিৎসা নিতে পারেন। পাশাপাশি এখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তিনি মরদেহ জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দেন।
ডা. আবু হেনা বলেন, মানুষ যখন হাসপাতালে আসে, সর্বশক্তি দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করে। আমাদেরও উচিত সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করা। এজন্য চাপ নিতে হয়, কিন্তু তাতে কোনো ক্ষতি নেই। এটা আমাদের দায়িত্ব।
রোগীদের হয়রানি কমাতে হাসপাতালেই কম মূল্যের ওষুধ সরবরাহের উদ্যোগ নিতে চান তিনি। তিনি বলেন, অনেকে বাইরে থেকে বেশি দামে ওষুধ কিনে আনে। আমি চেষ্টা করছি কোম্পানিগুলোকে বোঝাতে, যাতে কম দামে ওষুধ দেয়। প্রথমে ওষুধের দোকানিরা বাধা দিত। এখন তারা বুঝেছে।
ভবিষ্যতে হাসপাতালের ভেতরেই ওষুধের জন্য আলাদা ঘর তৈরি করতে চান, যেখানে রোগীরা সাশ্রয়ী দামে ওষুধ পাবেন। সবকিছু একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে যেন কোনো ওষুধ মিসিং না হয়। এছাড়াও প্রতিটি রোগীর জন্য আলাদা আলাদা বিল তৈরি করেছেন তিনি। এটির মাধ্যমে তিনি রোগীকে দেখাতে চান কত টাকা সরকার তার পেছনে খরচ করেছে। যাতে করে দেশপ্রেম বাড়ে।
এফএ/এএসএম