জাতীয়

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চায় আসক

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চায় আসক

গোপালগঞ্জ জেলায় চলতি বছরের ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্ব নির্ধারিত রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংঠনের নেতাকর্মী এবং সমর্থকদের হামলা চালানোর ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলপ্রয়োগে এখন পর্যন্ত ৫ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন বহু সংখ্যক। এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

Advertisement

আসক এ ঘটনায় একটি প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান করেছে। ২১ জুলাই থেকে ২২ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ২ দিনব্যাপী ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে।

আসক সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে নিহত, আহত, আটক/গ্রেফতার হওয়া নাগরিকদের পরিবার, স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সাধারণ নাগরিক, পেশাজীবী এবং কারাগার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

সমাবেশে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী সমাবেশের দিনে আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সমাবেশস্থলে আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ জন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সমাবেশের সামনে রাখা চেয়ার ভাঙচুর করতে থাকে। এ সময় সমাবেশে যোগ দেওয়া আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০ জন এনসিপি সমর্থক সমাবেশস্থল ছেড়ে ডিসি অফিসের দিকে চলে যান। এরপর সমাবেশে যোগ দেওয়া ব্যক্তিরা সংগঠিত হয়ে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় হামলাকারীদের ধাওয়া দিলে তারা ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সরে পরে। এ ঘটনার পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সমাবেশস্থলের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। সমাবেশ সকাল সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গোপালগঞ্জ শহরের প্রবেশমুখে আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকেরা অবস্থান নেওয়ায় পুলিশ এবং সেনা পাহারায় আনুমানিক দুপুর ১টার কিছু পরে সমাবেশস্থলে এসে পৌছান এনসিপির নেতারা।

Advertisement

দলটির নেতারা তাদের বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার পরপরই আওয়ামীলীগ ও তাদের সমর্থকেরা শহরের বিভিন্ন স্পটে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুরো শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল এবং গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে গুলিতে আহত ব্যক্তিদের সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে আহতদের মধ্যে ৪ জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে সমাবেশ শুরুর পূর্ববর্তী হামলা এবং সমাবেশের পরবর্তী সময়ের সংঘর্ষের ঘটনায় হামলাকারীদের পক্ষ থেকে তীব্র ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনার কথা জানা গেছে এবং কারো কারো হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল বলে জানা যায়। হামলার সময় ককটেল বিস্ফোরণ এর ঘটনা ঘটলেও হামলাকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে গুলির ঘটনা ঘটেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে, গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়া ১৬ জুলাই তারিখে রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। আসক এ ঘটনার সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে জানা যায়, এনসিপির নেতারা স্বল্প সংখ্যক সমর্থকের উপস্থিতিতে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়। এই মন্তব্যের পরপরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানিয়েছেন, বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ‘সাধারণ জনতা’ রাস্তায় নেমে আসে। এক পর্যায়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

গোপালগঞ্জ জেলায় ১৬ জুলাই রাত থেকে কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা চলাকালীন নির্বিচারে নাগরিকদের আটক ও গ্রেফতার করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের মতো অভিযোগও উঠেছে। ভয়ে সেখানকার মানুষকে নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। নিরপরাধ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জেলার যেসব এলাকায় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, সেসব এলাকাতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়ের অভিযোগ রয়েছে।

Advertisement

তথ্য অনুসন্ধানকালে জানা যায়, সমাবেশের আগের দিন স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমাবেশস্থলের সন্নিকটের দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রশাসনের নির্দেশে দোকানপাট বন্ধ রাখেন দোকান মালিকরা। সমাবেশস্থলের কাছাকাছি এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে আরও জানান, সমাবেশের দিন সকালে প্রশাসনের লোকজন জোরপূর্বক দোকান বন্ধ করে দেয় এবং কোথাও কোথাও দোকানের শাটার নামিয়ে দোকানের ভেতরে থাকা মানুষদের আটকে রাখার ঘটনাও ঘটে। সমাবেশের দিনে সকাল থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকেরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাদের হাতে লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র ছিল।

তথ্য অনুসন্ধানকালে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৬ জুলাই সংঘর্ষের ঘটনায় মোট ২৪ জনকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২১ জন সাধারণ নাগরিক এবং ২জন পুলিশ সদস্য এবং অন্য ১ জন হামীম, যিনি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালক।

২১ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে দায়িত্বরত জেল সুপার তানিয়া জামান এবং কারাগারে উপস্থিত এআইজি (প্রিজন) দেওয়ান মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম আসক প্রতিনিধিদের জানান, এ পর্যন্ত ১৮ জন শিশুকে আদালতের আদেশে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গোপালগঞ্জ কারাগার থেকে ১০০ বন্দিকে পিরোজপুর এবং ৫০ বন্দিকে বাগেরহাট কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ১৫০ বন্দির সবাই হাজতী। এই কারাগারে বন্দীর মোট ধারণক্ষমতা ৩৪৮; এর মধ্যে পুরুষ ৩২১ ও নারী ২৭। ২১ জুলাই ২০২৫ তারিখে মোট বন্দী ছিলেন ৭৫১ জন। অন্য জেলার কারাগারে বন্দি স্থানান্তরের কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, যখন ধারণক্ষমতার চেয়ে বন্দি বেশি হয়ে যায় তখন বন্দিদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এ রকম বিধান রয়েছে। আমরা বিধি অনুসরণ করেই পদক্ষেপ নিয়েছি।

কারা কর্তৃপক্ষ আসক প্রতিনিধিদের আরও জানান, ১৬ জুলাই আনুমানিক দুপুর ৩টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কারাগারে হামলা করে। হামলায় কারাগারের সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে, গার্ডরুম, গেস্ট ওয়েটিং রুমের ক্ষতিসাধন করে। কারাগারের প্রধান ফটক ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। এছাড়া কারাগারের অস্ত্রভান্ডার ভাঙার চেষ্টা করে। এই ঘটনায় কারা পুলিশ ৮০ রাউন্ড মিসফায়ার করে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। কারা কর্তৃপক্ষ সমাবেশকে কেন্দ্র করে শহরের উত্তেজনা অনুধাবন করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সব বন্দীকে লকআপে নিয়ে নেয়। পূর্ব সতর্কতার জন্য কারাগারে কোনো ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

জেপিআই/এএমএ/জিকেএস