এটি এমন একটি প্রশ্ন, যা বহু বছর ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কেউ বলে, একজন সফল উদ্যোক্তার জন্ম হয় বিশেষ গুণ নিয়ে, আবার কেউ বলে, কঠোর পরিশ্রম, জ্ঞান, ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যে কেউ হয়ে উঠতে পারে একজন সফল উদ্যোক্তা। বাস্তবতা হলো, কিছু মানুষ হয়তো জন্মসূত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে—যেমন নেতৃত্বের গুণ, ঝুঁকি নিতে পারার মানসিকতা বা উদ্ভাবনী চিন্তাধারা। কিন্তু কেবল এগুলো থাকলেই একজন মানুষ সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন না। তার জন্য প্রয়োজন হয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পরিকল্পনা এবং শৃঙ্খলার সাথে কাজ করার ক্ষমতা।
বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক বলেছেন, “When something is important enough, you do it even if the odds are not in your favor.” অর্থাৎ, কিছু জিনিস যদি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে প্রতিকূলতা থাকলেও তা করতে হয়। এটাই উদ্যোক্তার মানসিকতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখলে, আমরা দেখতে পাই—যারা একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে আজ কোটি টাকার ব্যবসার মালিক, তারা কেউ-ই অলৌকিকভাবে সাফল্য অর্জন করেননি। তারা হয়তো জন্মগতভাবে ধনী ছিলেন না, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা নিজেদের গড়ে তুলেছেন।
যেমন ধরা যাক স্যামসন এইচ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সম্প্রসারণ বা ফজলুর রহমানের মতো উদ্যোক্তাদের গল্প, যারা নিজের গুণে ও যোগ্যতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা সবাই কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে শিখেছেন, ভুল করেছেন, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতাও আজ নতুন উদ্যোক্তাদের পথ খুলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট উদ্যোক্তার প্রায় ৭৫ শতাংশই প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তা। অর্থাৎ, তারা পরিবার থেকে কোনো ব্যবসা উত্তরাধিকার হিসেবে পাননি। এর মানে তারা সবাই নিজেদের তৈরি করেছেন। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য জন্মগত প্রতিভা নয়, বরং নিজের উন্নয়নের ইচ্ছা ও চেষ্টা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
উদ্যোক্তা হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ‘ভয়’। অনেকেই ভাবে, ‘আমি তো ব্যবসা জানি না’, ‘পুঁজি নেই’, ‘পরিচিতি নেই’—এসব ভাবনাই মানুষকে পিছিয়ে দেয়। অথচ বিখ্যাত উদ্যোক্তা হাওয়ার্ড শুল্টজ, যিনি স্টারবাক্সের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি শৈশবে ছিলেন দরিদ্র। প্রথম দিককার দিনগুলোতে তার ব্যবসায়িক ধারণাকে কেউই গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন নিজের ওপর। তার ভাষায়, “Risk more than others think is safe. Dream more than others think is practical.” এ বিশ্বাসই তাকে সফল করেছে।
একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো—তার শেখার মানসিকতা। যিনি প্রতিনিয়ত শিখতে চান, তিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে পারেন। অনেক বড় উদ্যোক্তাই জীবনের শুরুতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন- জ্যাক মা— চীনের আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। ১০ বার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছেন, চাকরির আবেদন করেছেন ৩০টি প্রতিষ্ঠানে, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এমনকি কেএফসিতেও চাকরি পাননি। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। নিজের লক্ষ্য ঠিক রেখেছিলেন। আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এখন উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী। এর পেছনে একদিকে যেমন অনুপ্রেরণা কাজ করছে, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রশিক্ষণের অভাব একটা বড় চ্যালেঞ্জ। উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও কার্যকর পরিবর্তন দরকার। শুধু চাকরি খোঁজার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে যদি তরুণরা নিজের উদ্যোগে কিছু শুরু করতে আগ্রহী হন, তাহলে এই দেশ অনেক দূর এগোবে।
উদ্যোক্তা হওয়া একদিনের ব্যাপার নয়। এটি একটি যাত্রা। এ যাত্রায় প্রতিদিন কিছু শিখতে হয়, কিছু হারাতে হয় এবং প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করতে হয়। যারা এ যাত্রা শুরু করতে ভয় পান, তাদের জন্য বার্তা—শুরুটা ছোট হলেও হোক, সাহস করে এগিয়ে যান। কারণ সাফল্য জন্মগত নয়, তা অর্জন করতে হয়।
উদ্যোক্তা তৈরির জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন একটি ‘ইকোসিস্টেম’। যেখানে থাকবে মেন্টর, প্রশিক্ষণ, ফান্ডিং, নেটওয়ার্কিং সুযোগ ও বাস্তব ব্যবসার অভিজ্ঞতা। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে এমন একটি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে পারলে, হাজারো সম্ভাবনাময় তরুণকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
তবে সফল উদ্যোক্তা হওয়া মানে কেবল অর্থনৈতিক সফলতা নয়। উদ্যোক্তা মানে হচ্ছে এমন একজন মানুষ, যিনি সমস্যার সমাধান করেন, নতুন কিছু তৈরি করেন এবং অন্যদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করেন। এ কারণে উদ্যোক্তা হওয়া একটি সামাজিক দায়িত্বও বটে। যিনি শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্যও কিছু করেন—তিনি একজন সত্যিকারের উদ্যোক্তা।
সুতরাং, সফল উদ্যোক্তা জন্মায় নয়— তৈরি হয়। গড়ে ওঠে। সময়ের সাথে, অভিজ্ঞতার সাথে, নিজের ভুল থেকে শিখে, নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাগিদ থেকে। আমাদের সমাজে যত বেশি এই উপলব্ধি ছড়িয়ে পড়বে, তত বেশি মানুষ নিজেকে তৈরি করার সাহস পাবে। ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দরকার এমন এক প্রজন্ম, যারা উদ্যোক্তা হবে; যারা স্বপ্ন দেখবে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে জানবে।
শেষে বলা যায়, উদ্যোক্তা হওয়া একদিনের ব্যাপার নয়। এটি একটি যাত্রা। এ যাত্রায় প্রতিদিন কিছু শিখতে হয়, কিছু হারাতে হয় এবং প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করতে হয়। যারা এই যাত্রা শুরু করতে ভয় পান, তাদের জন্য বার্তা—শুরুটা ছোট হলেও হোক, সাহস করে এগিয়ে যান। কারণ সাফল্য জন্মগত নয়, তা অর্জন করতে হয়।
লেখক : দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
এইচআর/জেআইএম