পরিবেশবিষয়ক গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অবদানের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে পরিবেশ পদক-২০২৫ পেয়েছেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এম. ফিরোজ আহমেদ। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে পরিবেশ নিয়ে গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং নীতিগত পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। পদ্মা ও যমুনা সেতু নির্মাণের সময় ছিলেন পরিবেশগত বিশেষজ্ঞ।
সম্প্রতি পরিবেশ পদক পাওয়ার গল্প, পরিবেশ নিয়ে গবেষণাসহ বিস্তারিত বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন ড. এম. ফিরোজ আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ।
জাগো নিউজ: পরিবেশ পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। যাত্রার গল্পটা কীভাবে?
ফিরোজ আহমেদ: আগে কখনোই দেশে পরিবেশ পদকের জন্য আবেদন করিনি। অনেক সময় শুনতাম, পুরস্কারগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বা স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। এবার যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার, ভাবলাম আবেদন করি। আমি পদ্মা ও যমুনা সেতু প্রকল্পে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছি। এসব প্রকল্পে আমরা পাঁচজন বাংলাদেশি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট ছিলাম। পরিবেশের নানান জটিল বিষয় ছিল, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতাম।
পদ্মা সেতু এলাকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, যেটা যমুনা সেতু প্রকল্পেও করেছিলাম। পাশাপাশি, বাংলাদেশের আর্সেনিক সংকটের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা করেছি। ১৬০টির বেশি গবেষণাপত্র ও ২২টি বই রয়েছে আমার। বিশ্বের ২৮টি দেশে ৯৫টির বেশি বক্তৃতা দিয়েছি পরিবেশ ও টেকনিক্যাল বিষয়ে। তো এসব কিছুই আমার কাজ ছিল। এসব বিবেচনা করেই হয়তো পদক দিয়েছে।
জাগো নিউজ: পরিবেশ নিয়ে কাজ শুরু করলেন কখন?
ফিরোজ আহমেদ: স্বাধীনতার পরপরই। অল্প কথায় বলা কষ্টকর। প্রথম কাজ শুরু করি পানি দূষণ নিয়ে। তারপর বায়ু, ভূমি, আর্সেনিক—এসব নিয়ে কাজ করেছি। আমার গবেষণা জীবনের সিংহভাগ পরিবেশ নিয়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার পেয়েছি। বাংলাদেশে পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠনের প্রক্রিয়াও আমি শুরু করছিলাম। এটা শুরু হয় একটা প্রকল্পের মাধ্যমে। শুরুতে এর নাম ছিল ডিপার্টমেন্ট অব এনভারমেন্ট পলিউশন কন্ট্রোল, পরে এটি মন্ত্রণালয়ে রূপ নেয়। তখন এটা ছিল ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এম. ফিরোজ আহমেদ গত ২৫ জুন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাছ থেকে পরিবেশ পদক গ্রহণ করেন। ছবি: সংগৃহীত
জাগো নিউজ: আপনার পরিবেশ নিয়ে গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র কী ছিল?
ফিরোজ আহমেদ: পানি ও বায়ুদূষণ, আর্সেনিক, জীববৈচিত্র্য, এসব নিয়ে কাজ আছে আমার। বিশেষ করে বাংলাদেশের আর্সেনিক সংকট নিয়ে গবেষণাগুলো আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। সায়েন্স জার্নালে তিনটি গবেষণা আছে। এসব গবেষণায় বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের প্রকৃত কারণ কী, কীভাবে তা ছড়ায়, আর এ সমস্যা মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এসব উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুনপরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নাগরিকদেরও, এটা অনুধাবন জরুরিবছরজুড়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান, তবু কমে না দূষণজাগো নিউজ: ঢাকায় পরিবেশ সংকটের কারণ কী?
ফিরোজ আহমেদ: জনসংখ্যা বৃদ্ধিই পরিবেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। খালি জায়গা নেই, খাল-বিল ভরাট হচ্ছে, নদী ধ্বংসপ্রায়। শহর বাড়ছে, কিন্তু ভারসাম্যহীনভাবে।
জাগো নিউজ: সরকার আপনাদের পরামর্শ কতটা গুরুত্ব দেয়?
ফিরোজ আহমেদ: সবসময় না। তবে পদ্মা ও যমুনা সেতুর সময় আমাদের কথা গুরুত্ব পেয়েছে। পরিবেশগত দিক বিবেচনায় বাপার মাধ্যমেই আমি অনেক কাজ করেছি। তো সরকারও বাপাকে গুরুত্ব দেয়। তবে সব কিছু মানে না। আমরা সব সময় তাদের প্রেশার দেই। কিন্তু হানিফ ফ্লাইওভারের সময় বুয়েটের গবেষণায় প্রমাণ হয়, এতে যানজট কমবে না। আরও খারাপ হবে। আমি তখন বুয়েটে ছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকার এসে কাউকে জিজ্ঞেস না করেই ফ্লাইওভার করেছে। কিন্তু এখন কী যানজট কমেছে?
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এম. ফিরোজ আহমেদ। ছবি: জাগো নিউজ
জাগো নিউজ: পরিবেশ নিয়ে কাজ করার কোন ঘটনা বেশি মনে পড়ে?
ফিরোজ আহমেদ: পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। ট্যানারি সরানো নিয়ে আমি আশির দশক থেকে কাজ করি। সরানোর ডাকটা আমিই তুলেছি প্রথম। বহু সংগ্রামের পর সেটা সাভারে সরানো হয়। ট্যানারি সরলো, কিন্তু আরেকটা সমস্যার উদয় হয়। সেটা হলো ডায়িং ওয়েস্ট। কিন্তু ট্যানারি সরার পরেও ওখানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান হয়েছে, সেটা যথাযথ হয়নি ফলে দূষণ বেড়ে যায়।
আরও পড়ুনজীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তরুণদের করণীয়দূষণ প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে: পরিবেশ উপদেষ্টাজাগো নিউজ: পরিবেশ রক্ষায় নীতি-নির্ধারকদের কোন খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
ফিরোজ আহমেদ: বাংলাদেশ হলো পরিবেশ নিয়ে কাজ করার একটা উর্বর ভূমি। আমাদের পরিবেশগত সমস্যার শেষ নেই। যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারলেই অনেক। সমাধান করতে হলে গভীরে যেতে হয়, আসলে গভীরে গিয়ে কাজ করার লোক কম। একটা গাছ কাটছে সেটা নিয়ে সবাই মিলে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, এটা কোনো কাজ না। আমাদের উচিত উপকার-অপকার দুটো দিকেই নজর দেওয়া। উপকার বাড়াতে হবে, অপকার কমাতে হবে।
এই যে সবাই ভাবে ফ্লাইওভার বাড়াতে হবে। জেলা শহরের মানুষও চায়। ওপর দিয়ে গাড়ি চালানোই উন্নয়ন মনে হয়। কিন্তু এটা দূষণ বাড়াচ্ছে। তাই ঢাকার বায়ু ও শব্দদূষণ বিবেচনায় আন্ডারগ্রাউন্ড সড়কে নজর দেওয়া উচিত। আমি সবসময় আন্ডারগ্রাউন্ডের ব্যাপারে কথা বলে আসছি। এতে খরচ বেশি হওয়ার অজুহাত আছে। তবুও প্রতি বছর যদি ৫ কিলোমিটারও করা যায়, মন্দ কি। অন্তত শুরু করা উচিত।
আরও পড়ুনআমরা পরিবেশগত ঝুঁকির গহ্বরে চলে গেছিপরিবেশ দূষণে মানুষ দায়ীজাগো নিউজ: ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয় চরমে। আগামী ১০ বছরে পরিবেশ সংকট কোথায় যাবে বলে মনে করেন?
ফিরোজ আহমেদ: ঢাকার বায়ুদূষণ ভয়াবহ। বিশ্বের মধ্যে আমরা সবসময় শীর্ষে থাকি। একইভাবে শব্দদূষণ। আমাদের দেশে দূষণে ট্রান্সবাউন্ডারি ইফেক্ট কিন্তু অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক প্রকল্প নিচ্ছে, কিন্তু সেটা কাজ হয় না। এজন্য ভারত, নেপাল পাকিস্তান সবাই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সব দেশে দূষণ কমাতে হবে। ঢাকায় ডেভেলপাররা দিন দিন আবাসিক এলাকা বৃদ্ধি করছে। কিন্তু আমাদের ব্যালেন্স ডেভেলপমেন্ট হয় না। প্রতিটা শহর যদি হাসপাতাল, কর্মসংস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা প্রশাসনিক ভবন জেলা শহর স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো তাহলে ঢাকায় এত চাপ পড়ত না। পরিবেশেরও এত বিপর্যয় হতো না। ঢাকায় কেয়ারিং ক্যাপাসিটির দ্বিগুণ মানুষ থাকে। আমাদের দরকার স্ট্যাবল এবং শক্ত সরকার। অন্যান্য শহর যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের প্রয়োজন পূরণ করবে, ততক্ষণ মানুষ ঢাকায় আসতে থাকবে। আর ঢাকার পরিবেশ বিঘ্ন হতে থাকবে।
জাগো নিউজ: শহরের উন্নয়ন কী পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য?
ফিরোজ আহমেদ: আমাদের দেশে উন্নয়ন মানেই মনে করা হয় শহরে শুধু ফ্লাইওভার বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানানো। রাজনীতিবিদরা মনে করে এটাই উন্নয়নের প্রতীক। কিন্তু আমি এটিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখি। শহরের ভেতরে এসব উঁচু রাস্তা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে। যত উঁচু রাস্তা হয়, ধুলা তত বেশি ওপরে উড়ে গিয়ে বাতাসে মিশে যায়, ফলে বায়ুদূষণ আরও বাড়ে।
আরও পড়ুনআপনার বাসার আবর্জনাগুলো কী করছেনবর্জ্য-দূষণে হুমকির মুখে লাল কাঁকড়া বিচআমি বুয়েটে থাকাকালীন আন্ডারগ্রাউন্ড সড়ক নিয়ে বহুবার পরামর্শ দিয়েছি। নিচে রেললাইন বসানোর প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু ব্যয় বেশি হবে ভেবে সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। যারা দেশে এসব ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প আনে, তারা আমাদের পরামর্শ গুরুত্ব দেয় না। অথচ আমরা ‘ওপেন কাট মেথড’র প্রস্তাব দিয়েছিলাম, নিচে রাস্তা থাকবে, মানুষ চলাচল করবে, ওপরে জায়গা থাকবে পরিচ্ছন্ন ও খোলা। এতে দ্রুত ট্রাফিক সমস্যার সমাধান হবে।
বিশ্বের প্রায় সব মেগাসিটিতে আন্ডারগ্রাউন্ড যাতায়াত ব্যবস্থা আছে। তারাই এ পদ্ধতিতে যানজট নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। কলকাতায় বহু ফ্লাইওভার থাকা সত্ত্বেও, আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো চালুর পর তারা কার্যকর সমাধান পেয়েছে।
আরএএস/এমআরএম/এমএফএ/জেআইএম