একুশে বইমেলা

টু ফরটি নাইন স্ট্রীট, বেলরোজ: সহজ ভাবে গভীর সত্য

সহজ সরলে মরমে মরমে মনখুশির কবিতা লেখেন শামস আল মমীন। যা লেখেন পুরোটা মনোযোগ দিয়ে লেখেন। কোনো ফাঁক-ফোকর রাখতে চান না। মুহূর্তের সহজাত বিষয়াদি ঘটে যাওয়া ঘটন নিবীড় পরিচর্যায় শব্দের সৌন্দর্যে তুলে আনেন। ভাষা নিয়েও তেমন দেখিয়ে দেওয়ার হাপিত্যেশ নেই। কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়েও বাস্তবতার ওপর বিশ্বাসের বহাল তবিয়তে; যথাযথ উপমায় উপস্থিত চিত্রিত রূপকল্প নিজস্ব ভাবাদর্শে দীক্ষিত শামস আল মমীনের কবিতা। কোনো আলগা আস্তরণ পড়ে না। নিরীক্ষার নামেও বাড়াবাড়ি নেই। আমি মনে করি, একেকজন কবি একেকজন থেকে আলাদা হয়ে যায় অনুশীলন অনুশাসনে, হতে পারে গায়েবে প্রাপ্ত জ্ঞানকে উপস্থাপনে; সেখানে শামস আল মমীন কোনো ধরনের চাপ নেন না। মনের আনন্দে উপভোগ করে কবিতা লেখেন।

কবিতা হওয়া এবং না-হওয়া ব্যাপারটা একেকজনের কাছে একেকরকম। এরপরে ভালো কিংবা ভালো না-লাগা ব্যাপারটা আরও পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ কবিতা লেখায় নিজের মনখুশ করে লিখতে পারাটা আসল। সেখানে শামস আল মমীনের শক্তি সামর্থ্যের চমকপ্রদ কাহিনি; আপাত শান্ত স্বভাবে অশান্ত পৃথিবীর কথাসব লিখে দিতে পারেন শামস আল মমীন। সম্প্রতি এই কবির ‘টু ফরটি নাইন স্ট্রীট, বেলরোজ’ কবিতার বইটি পড়ে উপরোক্ত কথাগুলো আওড়ানো। বইটির নাম শুনে পাঠক হয়তো ভেবে নেবেন, কোনো অনুবাদের বই হয়তো; কিন্তু মলাট উলটিয়ে পড়া শুরু করলে বুঝবেন—এ এক দেশান্তরী প্রাণের মর্মভেদী কথনের আকুতিভরা বোধবিজ্ঞান—‘যদি লিখে যেতে চাও অমর পঙক্তি কিছু, তবেজেনে নিও কিসে এতো অভিমান রমণীর!জেনে নিও মাটি ও মানুষের গল্পগুলোও।নীরবে চেয়ে থাকা চোখ দেখে যদি বুঝি নিতে পারোএইখানেকোলাহলনেই কেন

হয়তো কোন একদিনঅমর পঙক্তিগুলো হেসে উঠবেতোমার টেবিলে(কবিদের প্রতি; পৃ-৭৮)

খ.আমাদের বুয়া...কাপড় কাচে, বাসন মাজে, ঘর মোছে।সকাল সকাল দরোজা খুলে কোনদিন তাকে বলি নাই

গুড মর্নিং...তার কোলের মেয়েটি প্যাসিফায়ার মুখে মুখ ফিরিয়ে দ্যাখেযেন আজও সে কথা না বলার অঙ্গীকারে অটল। তাকেদেখে মনে হয়, বুঝে গেছে সে মানুষে মানুষে ব্যবধান।(বুয়া; পৃ-২৯)

গ.‘আছেন বাহে... কাঁয়ো আছেন।’খোলা আকাশের নিচ থেকে, থেকে থেকে ভেসে ভেসেবিলাপ-ক্রন্দন, কান্দে রামনাথপুরকান্দে রাধা গোবিন্দ মন্দিরও।

মোর ছনঘর, বিছানা বালিশ, গোলাঘর পুড়ি ছাইমোর আলমারি, বিয়ার শাড়ি, কিছু নাই।(রীতা রানী কয়; পৃ-২০)

শামস আল মমীনের কবিতা ঘোরানো প্যাঁচানো কিংবা ঠেঁস কথার অর্থাৎ পরাবাস্তবতার অলংকারে ভার বইয়ে পারদর্শিতা প্রদর্শন করে না। যা করে—সরাসরিই সত্যি উদ্ঘাটনে সহজাত শব্দে সাদামাটা উচ্চারণেও কবিতা করে তোলা কিংবা কবিতা হয়ে ওঠা; তদুপরি শামস আল মমীনের কবিতা বুঝতে হলে আস্ত কবিতাটিই পাঠ করতে হবে। কিছু অংশ তুলে এনে বুঝিয়ে দেওয়া যে শামস আল মমীনের কবিতা এরকম, সেটি কোনোমতে সম্ভব নয়। শামস আল মমীন অল্প বাঁক নিয়ে সহজাত উপমার সারল্যে পরিমিত শিল্পিত চিত্রে যে গতিপথ নির্ণয় করেন, সেখানে একটা লাইনের সাথে আরেকটা লাইনের মিল-মহব্বত খুব; খণ্ডাংশ করা যায় না। ভাবের তাপিত মাধ্যম বিচ্ছিন্ন হয়। কবিতার মধ্যে যে গল্প থাকে সেটি অপূর্ণ থেকে যায়।

আরও পড়ুন হাজার রঙের ক্যানভাস: অনুভূতির মুখোমুখি  বিষণ্ন সন্ধ্যা কিংবা বিভ্রম: জীবনের কথা বলে 

০২‘টু ফরটি নাইন স্ট্রীট, বেলরোজ’ বইটি বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দিয়ে যায়। অস্থির পৃথিবীর সুস্থির স্বাক্ষর; কবি-জীবনের আমেরিকায় দীর্ঘ প্রবাসে আমেরিকাতেও নানা অসংগতি তুলে ধরেছেন কবিতায়। আমেরিকায় প্রবাস জীবনে নিজেদের সন্তানদের মধ্যে যেসব আচার-আচরণ পরিলক্ষিত হয়; সেসবের অনবদ্য দালিলিক প্রমাণ ও উপলব্ধি দিয়ে কবিতা লিখেছেন এ বইয়ে। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ওপর নিপীড়ন, হত্যা—এসবের প্রতিবাদও করেছেন কবিতায় আমেরিকাতে জীবনযাপন করে। এসব এই দেশে কল্পনাও করা যায় না। শুধু যে আমেরিকার নানা অসংগতি তুলে ধরেছেন; সেটি নয়, বাংলাদেশে দমন-নিপীড়ন, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন তীক্ষ্ণ অনুভবে বিশিষ্টতা দান করেছেন কবিতায়; পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া এলাকায় ১৮ হিন্দু বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খবরের কাগজে পড়ে আমেরিকায় বসে লেখেন যেন সুশাসনের নামে ভণ্ডামির কথাগুলো; শাসক বদলায় কিন্তু শোষণ একই, নিপীড়ন একই—টেলিভিশনে, খবরের কাগজে খবর আসেআপনাদের ভয় নেই, কিন্তুসকলেই জানে, ওরা ভয়ে আছে...(ওরা ভয়ে আছে; পৃ-১৯)

খ.দুর্গা ছিন্নমস্তা-আখিয়া নদীর মতো শান্ত, সর্বশান্ত।রীতা রানী কয়‘হামার বাড়িত আগুন নাগেয়া দিলে কাঁয়’।যারা আজীবন ঘাসফড়িং আর নীলাকাশ দেখেকবিতা লিখেছেন ওরাও বিব্রত খুব, ওরাওদুর্দিনে একটা কবিতা লিখতে চায়, কিন্তু হায়!(কেউ কিছু বলছে না; পৃ-১৭)

বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো মেট্রোরেল নিয়ে; শামস আল মমীনই সবার আগে এ দেশের মেট্রোরেল নিয়ে কবিতা লেখেন। কবিতাটি মেট্রোরেল ট্রায়ালের দিন লেখেন—বনের রাজার মতো হাঁটছেমেট্রোরেল। অপেক্ষমাণসাংবাদিক, সৌখিন ফটোগ্রাফারপদস্থ কর্মকর্তা, বিদেশি বিশেষজ্ঞ—সকলের চোখ স্থির।তার গায়ে চিক চিক করছে সকালের আহ্লাদী রোদ। সহসাসবাইকে চমকে বাজিয়ে দিলো সে তার প্রথম হুইসেল।(মেট্রোরেল, ১১ মে ২০২১; পৃ-৩৬)

শামস আল মমীনের কবিতায় আন্তরিক ভাব জড়াজড়ি করে থাকে। স্বদেশ প্রেম শামস আল মমীনের কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। রিদমিক চলন কবিতার প্রধান শক্তি। আমেরিকা আর নিজ দেশের মানুষের পরস্পরের ভাবগতিক বিভিন্ন আচরণ নিয়ে ‘বাঙালি মন’ শিরোনামে ১৫টি কবিতা ‘টু ফরটি নাইন স্ট্রীট, বেলরোজ’ বইটিতে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। কবিতাগুলোর প্রকাশভঙ্গি হঠাৎই মোচড় দেওয়া পাঠ-পরবর্তী পাঠকের অনেকদিন মনে থাকবে—দোস্ত আমার নতুন আইছে শহরেতাও প্রায় বছর ছয় সাতমাঝে মাঝে তার মনের কথা কইতে আসে—খুব সহজেই সেকালো রে কালো আর সাদারে সাদাকইতে পারে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে কয়আসছে মাসে নতুন বাড়িতে উঠতেছি।জানিস, ‘এলাকাটা খুউব ভালো—একটাও কালো মানুষ নাই।’তাইলে তো তুই হবি ওই মহল্লারপ্রথম কালো।(বাঙালি মন-১; পৃ-৪৫)

কী সহজভাবে এত গভীর সত্যকে তুলে ধরেছেন কবিতায়। এটাই শামস আল মমীনের কবিতা। বাঙালির মনের বিবিধ চলনও এই সিরিজের প্রতিটি লাইনে পেয়ে যাবেন। এই সিরিজের জন্য হলেও শামস আল মমীনের কবিতা পাঠক সমাদৃত হবে—এ আমার বিশ্বাস।

বইয়ের নাম: টু ফরটি নাইন স্ট্রীট, বেলরোজকবির নাম: শামস আল মমীনপ্রকাশক: জলধি প্রকাশনপ্রচ্ছদ: তাইফ আদনানমূল্য: ২৫০ টাকা।

এসইউ/জিকেএস