ভ্রমণ

আলীর গুহা থেকে মিরিঞ্জায় একদিন

সকালবেলা পাহাড়ি হাওয়া যেন শহরের ক্লান্ত প্রহরগুলোকে ধুয়ে মুছে দেয়। দূরের আকাশে মেঘের গালিচা, সামনে বিস্তৃত সবুজের ঢেউ আর পায়ের নিচে খাড়া পাহাড়ি পথ। ঠিক এমন এক মুহূর্তে আপনি যদি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেন, ভ্রমণের আনন্দ যেন বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এমন দুটি জায়গা আছে, যা প্রকৃতি আর ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক অপরূপ অভিজ্ঞতার দরজা উন্মোচন করে। একটির নাম মিরিঞ্জা ভ্যালি, অন্যটি আলীর গুহা।

বান্দরবানের লামা উপজেলায় অবস্থিত মিরিঞ্জা ভ্যালি অনেকের কাছেই এখনো অচেনা। লামা থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের চূড়ায় এ যেন এক মেঘে মোড়া উপত্যকা। এখানে দাঁড়ালে মনে হয় আপনি আকাশের অনেক কাছাকাছি এসে গেছেন। যেদিকে তাকান, কেবল সবুজ আর সাদা মেঘের খেলা। ভোরের আলো যখন পাহাড়ের গায়ে পড়ে; তখন মিরিঞ্জার সৌন্দর্য যেন নিজেকে রাঙিয়ে তোলে নতুন রূপে।

মিরিঞ্জা ভ্যালিতে আছে সরকারি পর্যটনকেন্দ্র, যেখানে আছে ‘টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট’ নামে পরিচিত একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। এখান থেকে দেখা যায় চারপাশের পাহাড়, নিচে বিস্তৃত সমতল ভূমি। কখনো কখনো দূর-দূরান্তের নানা রেখাও। যারা ছবি তুলতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি একটি স্বপ্নের মতো জায়গা।

রাতযাপনের জন্য এখানে আছে কাঠের তৈরি জুমঘর ও তাঁবু। সকালে পাখির ডাক আর মেঘের ছায়ায় ঘুম ভাঙার স্বাদ একেবারে অন্যরকম। খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। স্থানীয় খাবার, বারবিকিউ, ভাত-তরকারি অথবা নিজের পছন্দমতো থাকছে রান্না করার সুযোগ।

মিরিঞ্জার শান্ত প্রকৃতি উপভোগের পাশাপাশি যারা একটু অ্যাডভেঞ্চার চান; তাদের জন্য আদর্শ গন্তব্য আলীকদমের ‘আলীর গুহা’। এটি স্থানীয়ভাবে ‘আলীর সুড়ঙ্গ’ নামে পরিচিত। মাতামুহুরি নদীর পাশ দিয়ে কিছুটা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যেতে হয় এই গুহার মুখে। এরপর শুরু হয় এক ছমছমে, অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের অভিজ্ঞতা। যেখানে প্রতিটি পা ফেলার আগে দরকার সতর্কতা। মনে জাগে হাজারো প্রশ্ন, এই গুহার শেষ কোথায়?

গুহার ভেতর ঢুকতেই বোঝা যায়, এটি নিছক কোনো ছায়া নয় বরং একটি জীবন্ত ইতিহাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পানির স্রোতে গঠিত এই প্রাকৃতিক গঠন আজ পর্যটকদের রোমাঞ্চিত করে। গুহার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো মশাল বা টর্চের আলোতে পথ খুঁজে নিয়ে। অন্ধকারে বাঁদুড়ের ডানা ঝাপটানো শব্দ, স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের গায়ে জলের ছাপ আর হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস; সব মিলিয়ে মনে হয় আপনি কোনো উপন্যাসের চরিত্র।

আরও পড়ুন কখনো গিয়েছেন উৎমা ছড়ায়?  কোলাহলমুক্ত নডালিয়া সমুদ্রসৈকত 

এ গুহা সম্পর্কে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। স্থানীয়রা বলেন, কেউ কেউ এখানে পথ হারিয়েছে আবার কেউ হয়েছে অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সাক্ষী। যদিও এখন গাইড ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। তবু প্রকৃত ভ্রমণপ্রেমীরা এখনো আলীর গুহাকে এক ধরনের আত্মঅন্বেষণের যাত্রা বলে মনে করেন।

একদিকে মিরিঞ্জা ভ্যালির মেঘ, সূর্যোদয় আর শান্ত প্রকৃতি; অন্যদিকে আলীর গুহার রহস্য ও শিহরণ। এই দুই জায়গা এক সফরে দেখে ফেলা মানে প্রকৃতি ও রোমাঞ্চের সাক্ষী হ‌ওয়া। কেউ যদি প্রকৃতি, নির্জনতা আর অ্যাডভেঞ্চারের যুগলবন্দি খোঁজেন, তবে এ রুটে ঘোরাই হতে পারে আপনার জীবনের স্মরণীয় একটি ট্রিপ।

প্রথমে আলীর গুহার পথে যেতে চাইলে, ঢাকা থেকে সরাসরি সবচেয়ে সুবিধাজনক হলো; শ্যামলী বা হানিফ পরিবহনের বাসে করে আলীকদম পৌঁছানো। এই রুটে সরাসরি বাস চলাচল করে, ভাড়া ক্লাসভেদে গড়ে ৮৫০ টাকা, কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে। সরাসরি আলীকদম পৌঁছালে সময় বাঁচে এবং যাত্রা সহজ হয়।

তবে চাইলে বিকল্প পথে চকরিয়া হয়ে আলীকদম যাওয়া যায়। কক্সবাজারগামী যে কোনো বাসে চকরিয়ায় নেমে সেখান থেকে আলীকদম যেতে পারবেন। চকরিয়া পর্যন্ত ভাড়া শ্রেণিভেদে ৯৫০ টাকা থেকে শুরু করে প্রায় ২২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। চকরিয়া নেমে বাসস্ট্যান্ড বা নতুন টার্মিনাল থেকে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে আলীকদমগামী লোকাল বাস পাওয়া যায়।

বাস ছাড়াও ‘চান্দের গাড়ি’ নামক লোকাল জিপে করে যাওয়ার সুযোগ আছে। জনপ্রতি ভাড়া আনুমানিক ৬৫ টাকা। দলবদ্ধভাবে গেলে রিজার্ভ করা যায় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। তবে দরদাম করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। বাসে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা আর চান্দের গাড়িতে সময় কিছুটা কমে আসতে পারে।

আলীকদম পৌঁছানোর পর আপনাকে যেতে হবে মংচুপ্রু পাড়ায়। ইজিবাইক বা হেঁটে ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই পাড়াটিতে পৌঁছে যাবেন। এখান থেকে প্রবাহিত টোয়াইন খাল পার হয়ে শুরু হবে আলীর গুহার আসল যাত্রা। পাহাড় ও ঝিরিপথ পেরিয়ে ২০-৩০ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে রহস্যঘেরা গুহার। পুরো এলাকা ঘুরে দেখতে আলীকদম থেকে শুরু করে ফেরত আসা পর্যন্ত প্রায় ৩ ঘণ্টার মতো সময় ধরে রাখতে পারেন।

যদি একই দিনে মিরিঞ্জা ভ্যালিও ঘুরতে চান, তবে দুপুরবেলায় আলীকদম সদর থেকে লামা-আলীকদম সড়ক ধরে রওয়ানা হতে হবে। সিএনজি, জিপ বা লোকাল বাসে করে সহজেই মিরিঞ্জা ভ্যালির কাছাকাছি যাওয়া যায়। সাশ্রয়ী ভ্রমণ পরিকল্পনায় যদি একদিন ও একরাত সময় রাখতে পারেন, তবে গড়ে ৩০০০ টাকার মধ্যে আলীর গুহা ও মিরিঞ্জা ভ্যালি উভয় স্পট ঘুরে ফেরা সম্ভব। গ্রুপ ট্যুরে গেলে অনেকটা সাশ্রয় হয়।

এসইউ/জিকেএস