দেশজুড়ে

‘আব্বু, শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় নাই’ শেষ কথা ছিল শহীদ আব্দুল্লাহর

চব্বিশের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকার রাজপথে নেমে আসে বিজয়ের উল্লাস। ঢাকার তাঁতীবাজারে চলছিল এমনই এক বিজয় মিছিল। সেই মিছিলে ছিলেন যশোরের বেনাপোলের তরুণ আব্দুল্লাহ। সেই মুহূর্তে যখন মানুষ হাসছিল, একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিল, তখনই আকাশ কাঁপিয়ে ছুটে আসে গুলির শব্দ। মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় চারদিক। সেই গুলির একটি গিয়ে লাগে আব্দুল্লাহর ঠিক কপালের মাঝখানে। ঢাকার রাস্তায় মাথায় গুলি খেয়ে ঢলে পড়েন ২৩ বছর বয়সী তরুণ।

আব্দুল্লাহ না থাকলেও রয়ে গেছে তার কিছু স্মৃতি, কপালের মাঝখানে গুলির দাগে লেখা এক অমর প্রতিরোধের ইতিহাস।

শহীদ আব্দুল্লাহ ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়তেন ঢাকায় বড় বোনের বাসায় থেকে। গ্রামের বাড়ি যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানার সীমান্তবর্তী বড়আঁচড়া টার্মিনালপাড়ায়। দিনমজুর বাবা আব্দুল জব্বার আর গৃহিণী মা মাবিয়া বেগমের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট, কিন্তু স্বপ্ন ছিল সবচেয়ে বড়। মেধা, বিনয় আর নেতৃত্বগুণে আব্দুল্লাহ পরিবার-পরিজনের ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। স্বপ্ন ছিল একদিন দেশের জন্য কিছু করে দেখাবেন।

কিন্তু সেই স্বপ্ন থেমে যায় রাজধানীর তাঁতীবাজার মোড়ে। ৫ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে শান্তিপূর্ণ মিছিলে ব্যানার হাতে দাঁড়ানো অবস্থায় তার কপালের মাঝখানে আঘাত হানে পুলিশের গুলি। পড়ে থাকেন রক্তাক্ত অবস্থায় দু-তিন ঘণ্টা, সাহায্যের কোনো হাত কেউ বাড়িয়ে দেয়নি। পরে পথচারীদের সহায়তায় মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে।

সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে তার মাথা থেকে গুলি বের করা হয় বটে, কিন্তু অবস্থার জটিলতা কাটেনি। এর মধ্যেই শুরু হয় আরেক ট্র্যাজেডি, চিকিৎসা না-পাওয়ার লড়াই। ১০ আগস্ট তার অবস্থার অবনতি সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জোরপূর্বক ছাড়পত্র দেয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ফিরে আসেন বেনাপোলে। কিছুদিনের মধ্যে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। এরপর খুলনা মেডিকেলে, আবার ঢাকা মেডিকেলে, শেষে সিএমএইচে। এ চক্রে ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত হার মানেন এই তরুণের জীবনের লড়াই।

‘ঢাকা থেকে যখন বাড়ি আসতো, দূর থেকেই ডাক দিতো মা মা বলে। এখনো সেই ডাক কানে বাজে কিন্তু ছেলে আর ফেরে না।’

২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর, সকাল ৮টা। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) বিছানায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন শহীদ আব্দুল্লাহ। যাকে নিয়ে পরিবার স্বপ্ন দেখেছিল একজন প্রশাসক, গবেষক বা শিক্ষক হবেন-তিনি এখন ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাস গৌরবের, চোখ ভেজানো এক সাহসের প্রতিচ্ছবি।

আন্দোলনের সময় তার পাশে দাঁড়ানো বন্ধু শাওন হেসেন জানান, আব্দুল্লাহ ছিলেন সহজ-সরল, পড়ালেখায় মনোযোগী চিরসজাগ, সৎ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কখনোই বৃথা যায় না।

আরও পড়ুন:

৫ আগস্ট লংমার্চে গিয়ে না ফেরা মুন্নার খোঁজে পাগলপ্রায় মা-বাবা শহীদদের ঘরে কান পাতলে আজও শোনা যায় কান্নার রোল

আব্দুল্লাহর প্রতিবেশী ও আত্মীয় বাংলা ট্রিবিউনের বেনাপোল প্রতিনিধি সেলিম রেজা বলেন, তার মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের শোক নয়, বরং একটি দেশের বিবেকের প্রশ্ন। শহীদ আব্দুল্লাহ শুধু একটি নাম নয়- তিনি এখন হয়ে উঠেছেন একটি প্রতিরোধের প্রতীক, এক অনাগত ন্যায়ের ইতিহাসের ভূমিকা। রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকের রক্তের মূল্য দিতে ব্যর্থ, তখন এই তরুণরা ইতিহাসের পাতায় নিজেদের রক্তেই লিখে যান, কীভাবে গণতন্ত্র নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়।

তার আরেক প্রতিবেশী ভাবি সম্পর্কের শিল্পী খাতুন বলেন, আব্দুল্লাহ আমাদের প্রতিবেশী ছিল। সে ছোট থেকে ছিল শান্ত, শিষ্ট ও ভদ্র। আমাদের চোখের সামনে মানুষ হয়েছে। অনেক অভাব কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে। এলাকার ছোট ছোট ভাইবোন, বড় ভাইদের, আত্মীয়স্বজনসহ সবার সাথে সুন্দর ব্যবহার করতো। বন্ধুদের সাথে ছিল সুসম্পর্ক। সবার বিপদে এগিয়ে আসতো।

ঢাকা থেকে কলেজ ছুটিতে বাড়ি এসে পড়াশোনার পাশাপাশি আশেপাশের সবার খোঁজ নিতো। খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করে ঢাকায় গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করে একটা চাকরি করে নিজের ও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় ৫ আগস্ট দুপুরে কপালে গুলিবিদ্ধ হয় আব্দুল্লাহ। তিন মাস চিকিৎসার পর মৃত্যু। ঘটনাটি অনেক কষ্টদায়ক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেনাপোল পৌর শাখার সাবেক সদস্যসচিব সাজেদুর রহমান শিপু বলেন, আব্দুল্লাহ আমার ক্লাসমেট। আমরা বেনাপোল হাইস্কুলের ২০১৭ এসএসসি ব্যাচের ছাত্র ছিলাম। সে একজন ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও মেধাবী ছাত্র ছিল। ঢাকায় পড়াশোনা করতো শহীদ সোরওয়ার্দী কলেজে। ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হন।

‘শেষবার ফোনে বলেছিল, ‘আব্বু, শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় নাই’, দেশ মুক্ত হয়ে গেছে।’ আমি ওর কণ্ঠে বিজয়ের উত্তেজনা টের পেয়েছিলাম, সেটিই ছিল আমাদের শেষ কথা।’

তিনি আরও জানান, আমাদের পক্ষ থেকে ছোটখাটো সহযোগিতা করা হয়েছে। আমরা সবসময় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তার জন্য সরকার যে ফান্ড দেবে তার বন্দোবস্ত করতে পেরেছি। বেনাপোল পৌর গেটটি তার নামে করার জন্য উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে। সেটা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে অনুমোদনের জন্য। আমাদের পক্ষ থেকে উপদেষ্টা মহলেও যোগাযোগ করছি।

আরও পড়ুন:

স্বপ্নের রঙিন ঘর-বোনের বিয়ে হলেও নেই কামরুল গুলিবিদ্ধ হয়েও আহতকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন শহীদ রুবেল

তিনি বলেন, সরকারিভাবে তার পরিবারকে এককালীন ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হবে, যা প্রক্রিয়াধীন বলে জেনেছি। এ ব্যাপারে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে প্রয়োজনে সাংবাদিকদের ডেকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।

শহীদ আব্দুল্লাহর মা মাবিয়া বেগম বলেন, আমার ছেলে ছোটবেলায় খুব ভয় পেতো। আঁধার ঘর, হঠাৎ কোনো শব্দ সব কিছুতেই কেঁপে উঠত। কে জানত সেই ভয় পাওয়া ছেলেটাই একদিন দেশের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়াবে।

তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ঢাকা থেকে যখন বাড়ি আসতো, দূর থেকেই ডাক দিতো মা মা বলে। এখনো সেই ডাক কানে বাজে কিন্তু ছেলে আর ফেরে না।

আব্দুল্লাহর বাবা আব্দুল জব্বার বলেন, শেষবার ফোনে বলেছিল, ‘আব্বু, শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় নাই, দেশ মুক্ত হয়ে গেছে।’ আমি ওর কণ্ঠে বিজয়ের উত্তেজনা টের পেয়েছিলাম, সেটিই ছিল আমাদের শেষ কথা।

বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি তাকে ভালো শিক্ষা দিতে, সে ছিল পরিবারের গর্ব। সরকার কোথাও কোথাও শহীদ পরিবারকে সহায়তা দিচ্ছে শুনি, কিন্তু আমরা শুধু আশ্বাসই পাচ্ছি। আমাদের প্রতি রাষ্ট্রের যে সহানুভূতি থাকার কথা, তা এখনো পাইনি।’

শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ড. কাজী নাজিব হাসান বলেন, ২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ৫ আগস্ট ঢাকায় বিজয় মিছিলে যশোরের বেনাপোলের আব্দুল্লাহ নামে এক ছাত্র কপালে গুলিবিদ্ধ হন। পরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীদ হন। শহীদ আব্দুল্লাহর পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সময় সহায়তা ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। সরকারি সব অনুষ্ঠানে তার পিতাকে সম্মানিত করা হয়। এছাড়া জাতীয়ভাবে জুলাই-আগস্টে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা ও ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা রয়েছে বলে জানতে পেরেছি।

তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে শহীদ আব্দুল্লাহর পরিবারকে সহায়তার জন্য তাদের পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর ও অন্যান্য তথ্য উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। দ্রুত তারা সরকারি এককালীন অনুদান ৩০ লাখ টাকা, ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ও মাসিক একটি ভাতা পাবেন।

শহীদ আব্দুল্লাহর আত্মত্যাগ শুধু তার পরিবারের নয়, এটি বেনাপোলবাসীর গর্ব। সেই গর্ব চিরস্মরণীয় করে রাখতে এলাকাবাসী ও তার পরিবারের দাবি, বেনাপোল পৌরসভার প্রবেশদ্বারে থাকা প্রধান গেটটির নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ আব্দুল্লাহ গেট’ রাখা হোক। পাশাপাশি গেটটির পাশে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি তোলেন এলাকাবাসী, যাতে লেখা থাকবে একজন তরুণ কীভাবে মাথার রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখে গেছেন, কীভাবে ঢাকার রাজপথে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক নিপীড়িত তরুণ গড়েছেন স্বৈরাচারবিরোধী এক নতুন অধ্যায়।

এমএন/এমএস