শিক্ষা, জ্ঞান এবং দক্ষতা — এই তিনটি মৌলিক ধারণা মানব সমাজের বিকাশে অমূল্য ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের কাছ থেকে শুরু করে আধুনিক দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং প্রযুক্তিবিদগণ এগুলোর সংজ্ঞা দিয়েছেন, এবং সময়ের সাথে সাথে এসব ধারণার রূপ ও কার্যকারিতা পরিবর্তিত হয়েছে। আজকের বিশ্বে জ্ঞান অর্জন আর শিক্ষা আর শুধু পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই - এটি এখন হয়ে উঠেছে গতি পরিবর্তনশীল (dynamic), ডিজিটাল, সহযোগিতামূলক (collaborative), এবং ব্যবহারিক (practical)। এই যুগে জ্ঞান, শিক্ষা আর দক্ষতার ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে: এটি এখন আর কেবল তথ্য জানার বিষয় নয়, বরং তথ্যকে ব্যবহার করা, বিশ্লেষণ করা, নতুন কিছু তৈরি করা এবং বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে তা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সক্ষমতা।
শিক্ষা (Education)-জ্ঞানের সূতিকাগারশিক্ষা বা Education হলো একটি সংগঠিত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বা সমাজ জ্ঞান, দক্ষতা, মনোভাব, নৈতিকতা, এবং সামাজিক মূল্যবোধ অর্জন করে। এটি ব্যক্তির মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়তা করে। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী নতুন তথ্য শিখে এবং প্রাসঙ্গিক দক্ষতাগুলি অর্জন করে। শিক্ষা শুধু যে বিষয় বা দক্ষতা শেখায় তা নয়, বরং ভালো মানুষ হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করে। শিক্ষা সামাজিক সম্পর্ক, শৃঙ্খলা এবং সহযোগিতা শিখায় যা একটি সমাজের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষা ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং মানসিক বিকাশে সহায়তা করে, তাকে সমৃদ্ধ ও সক্ষম করে।
শিক্ষা, জ্ঞান এবং দক্ষতার পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও আন্তঃসম্পর্কিত। শিক্ষা জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া, যেখানে একজন শিক্ষার্থী নতুন ধারণা ও তথ্য অর্জন করে, এবং সেই জ্ঞানকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এজন্য, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান এর কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। তাই, শিক্ষা-কে শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবেই নয়, বরং দক্ষতা, সমস্যা সমাধান এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত। এটি নিশ্চিত করতে হলে, আমাদের শিক্ষার কাঠামোকে আরও প্রাসঙ্গিক এবং গঠনমূলক করে তুলতে হবে, যেন নতুন প্রজন্ম শুধু জ্ঞানী না হয়ে, বরং নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল এবং সমাজের উন্নয়নে সক্ষম ব্যক্তি হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
প্লেটো মনে করতেন, শিক্ষা হল আত্মার শুদ্ধি এবং তাকে সত্য ও ন্যায়ের দিকে পরিচালিত করা। তার দৃষ্টিতে, শিক্ষা ছিল আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মার সৃষ্টির প্রক্রিয়া। ডিউইয়ের (John Dewey) মতে, শিক্ষা জীবনের জন্য প্রস্তুতি নয়, বরং জীবনই শিক্ষা। তিনি বলেন, শিক্ষা এক ক্রমবিকাশী প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষার্থী নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে, চিন্তা ও সমস্যা সমাধানে দক্ষ হয়।
“Education is not preparation for life; education is life itself.” একুশ শতকের শিক্ষা দার্শনিক ম্যাক্সিন গ্রিন (Maxine Greene) বলেন শিক্ষা হচ্ছে স্বাধীনতা, অবস্থান এবং স্ব-পরিচয় তৈরি করার প্রক্রিয়া। তিনি শিক্ষাকে একটি মনের মুক্তির পথ হিসেবে দেখেছেন। “Education is the means by which we learn to live together in a world that demands new ways of thinking and acting.”
জ্ঞান বা Knowledge এর সংজ্ঞা এবং দার্শনিক ধারণাইংরেজিতে ‘জ্ঞান’ শব্দের মূল শব্দটি হল ‘’Knowledge’’. তবে জ্ঞান শব্দের বিপরীতে স্থান বিশেষে ইংরেজিতে wisdom, understanding, consciousness, sense, know, learning ইত্যাদি শব্দসমূহ ব্যবহৃত হয়। অনেকে ‘Skill’ কে জ্ঞান শব্দের সাথে তুলনা করেন। শব্দ দুটি এক নয় তবে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। দক্ষতা (Skill) হল জ্ঞান এবং অনুশীলনের ফসল। কেউ হয়ত গাড়ি চালতে জানে (জ্ঞান), কিন্তু সে যদি বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে না পারে এবং চর্চা না করে, তাহলে তার দক্ষতা (driving skill) হবে না। Skill কে সরাসরি জ্ঞান বলা যায় না। Skill হলো জ্ঞানের ব্যবহারিক রূপ, যা অভ্যাস ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গঠিত। Skill এর বিভিন্ন শ্রেণি আছে, যেমন Hard Skill, soft skill, cognitive skill, Life skill ইত্যাদি।
বিশ্বের অনেক বিখ্যাত দার্শনিক এবং মনীষী জ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞা বা ধারণা দিয়েছেন। যেমন-
• প্লেটো (Plato) বলছেন, "Knowledge is justified true belief." অর্থাৎ “জ্ঞানে সত্য থাকতে হবে, বিশ্বাস থাকতে হবে, এবং সে বিশ্বাসের যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে হবে।” শুধু বিশ্বাস নয়, বিশ্বাসটি সত্য এবং যৌক্তিকভাবে প্রমাণযোগ্য হতে হবে। তাহলেই তা’কে জ্ঞান বলা যাবে। অর্থাৎ শেখা এবং প্রয়োগ। জ্ঞানে সত্যতা আছে মানে সেটা কোন ফেক কিছু বা মিথ্যা থাকতে পারবে না এবং তা প্রমাণ করতে হবে আর সেটাই প্রয়োগ।
• অ্যারিস্টটল (Aristotle) বলেছেন, "All men by nature desire to know." মানে হল, “প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে জানার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জন্মায়।” তিনি জ্ঞানকে "reasoned truth", অর্থাৎ যুক্তিনির্ভর সত্য হিসেবে দেখেছেন। জ্ঞান আসে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, কিন্তু তা প্রক্রিয়াজাত হয় যুক্তির সাহায্যে। অ্যারিস্টটল এর এই ব্যাখ্যা প্লেটোর সাথে মিল আছে। জ্ঞান সত্য হবে এবং যৌক্তিক হবে।
• ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) বলছেন, "Knowledge is the organization of perceptions." অর্থাৎ “জ্ঞান হলো উপলব্ধিগুলোর সংগঠিত রূপ।” তিনি মনে করতেন যে জ্ঞান আমাদের অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধির কাঠামো থেকে উদ্ভূত। ইমানুয়েল কান্ট কিন্তু সত্য, যুক্তি এবং প্রয়োগের ব্যাপারে পরিষ্কার কিছু বলেননি।
• জন লক (John Locke) এর মতে "The mind is a blank slate (tabula rasa)." অর্থ “মনের ক্যানভাস জন্মের সময় সাদা থাকে, সময়ের সাথে জ্ঞান আসে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।” অর্থাৎ তার মতে জ্ঞান আসে অনুভব ও অভিজ্ঞতা থেকে। জন লক এর জ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা ইমানুয়েল কান্ট এর সাথে মিল পাওয়া যায়।
• ব্রুনার (Jerome Bruner – শিক্ষাবিদ) এর মতে, "Knowledge is not a product to be transmitted, but a process to be constructed." মানে হল, “জ্ঞান কোনো বস্তু নয় যা শুধু শেখানো যায়, বরং এটি গঠিত হয় শেখার প্রক্রিয়ায়।” অর্থাৎ শিখতে হবে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যা প্রমাণ করা যাবে।
জ্ঞানের বিভিন্ন সংজ্ঞা বা ধারণাগুলি বুঝলাম। তাহলে সার্বজনীন ভাবে ‘জ্ঞান’ এর কোন ধারণাটি গ্রহণযোগ্য। বিশ্বব্যাপী জ্ঞান সম্পর্কিত প্লেটোর ধারণাটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। জ্ঞান সম্পর্কিত এর চেয়ে ভালো ধারণা কেউ দিতে পারেনি। সত্য, বিশ্বাস এবং যৌক্তিক ভিত্তি এই নিয়েই জ্ঞান। ‘আমি বিশ্বাস করি সূর্যের চারিপাশে পৃথিবী ঘুরে’। এটা প্রমাণিত সত্য এবং এটা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির মাধ্যমে এবং বৈজ্ঞানিক এবং যৌক্তিক ভাবেই প্রমাণিত। অর্থাৎ প্রমাণ করা হয়েছে যে এই জ্ঞান সত্য এবং যৌক্তিক যা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে।
‘জ্ঞান’ বা Knowledge এর ব্যাপারে প্লেটোর ধারণা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য কারণ এটি, যুক্তিবাদী (rational) ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক (empirical) দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, এবং শিক্ষাগত প্রেক্ষাপটে ব্যবহারযোগ্য। আধুনিক দর্শন ও epistemology (জ্ঞানতত্ত্ব) এর ভিত্তি এই সংজ্ঞার ওপর দাঁড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণালয়ে জ্ঞানের মূল্যায়ন, পরীক্ষা, বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এই তিনটি উপাদানই গুরুত্ব পায়।
জ্ঞান অর্জন কীভাবে হয়?এখন বলি আমরা জ্ঞান কীভাবে অর্জন করি। জ্ঞান বিভিন্নভাবে অর্জন বা শেখা যায়। যেমন-
• ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে (Through the Senses) ঃ দেখা, শোনা, ঘ্রাণ নেওয়া, স্পর্শ করা, স্বাদ নেওয়ার মাধ্যমে। শিক্ষক বোঝাচ্ছেন, আপনি শুনছেন ও বোঝার চেষ্টা করছেন। এর ফলে জ্ঞ্রান অর্জিত হচ্ছে।
• পাঠ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে (Through Reading and Studying) ঃ পাঠ্যবই, ধর্মীয় বই, প্রবন্ধ, সংবাদ, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, পড়া এবং ধারণ করা। যেমন বিজ্ঞান বই পড়ে আপনি নিউটনের সূত্র শিখলেন।
• অভিজ্ঞতা থেকে (From Experience) ঃ কাজ করতে করতে শেখা, ব্যর্থতা ও সাফল্য থেকে শেখা। বলা যায় বারবার রান্না করতে করতে কেউ ভালো রাঁধুনি হয়ে যায়।
• পর্যবেক্ষণ থেকে (Through Observation)ঃ চারপাশের ঘটনা, মানুষ, প্রকৃতি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে শেখা। একটা বাচ্চা দেখে দেখে অনেক কিছুই করতে এবং বলতে শেখে।
• শিক্ষকের কাছ থেকে (Through Teaching & Instruction)ঃ শিক্ষক, গাইড, মেন্টর বা কোচ থেকে শেখা। এটি হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বড় মাধ্যম।
• আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে (Through Discussion and Debate)ঃ মতবিনিময়, বিতর্ক, গ্রুপ ওয়ার্কের মাধ্যমে নতুন চিন্তা ও ধারণা শেখা।
• ভাবনা ও যুক্তির মাধ্যমে (Through Thinking and Reasoning) ঃ নিজে চিন্তা করে, যুক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধান করে জ্ঞান অর্জন। একে বলা হয় reflective knowledge।
• আধ্যাত্মিক বা অন্তর্দৃষ্টি থেকে (Through Intuition or Spiritual Insight)ঃ ধ্যান, আত্মজিজ্ঞাসা বা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান।
তবে যে জ্ঞানই অর্জন করিনা কেন সেটা প্লেটোর ধারণার সাথে মিল থাকতে হবে। তবে আমরা ধর্মীয় অনেক জ্ঞান প্লেটোর ধারণার সাথে মিলাতে পারব না- সেটা শুধু বিশ্বাস এবং চর্চা। উপরের আলোচনা অনুযায়ী তাই যা কিছুই বলা হয় বা চর্চা করা হয় তা-ই কিন্তু জ্ঞান নয় বা জ্ঞানের কথা নয়।
২১শ শতকে জ্ঞানের ধারণা২১শ শতকের জ্ঞানের ধারণা অনেক বেশি প্রসারিত ও বহুমাত্রিক (multidimensional)। তবে প্লেটোর ধারণাটি এখনো দার্শনিক ও একাডেমিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। ২১শ শতকের জ্ঞানের ধারণাগুলি হল-
• জ্ঞান একটি পরিবর্তনশীল ও ক্রমবিকাশমান প্রক্রিয়াঃ জ্ঞান এখন আর স্থির কিছু নয়; এটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল।
বিশ্বের তথ্য প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে — ফলে সত্য বা তথ্য একদিনে পুরোনো হয়ে যেতে পারে। Pluto একসময় গ্রহ ছিল, এখন নয়। তাই এখনকার জ্ঞান হলো আপডেট হওয়া তথ্য যোগ বিশ্লেষণ যোগ প্রসঙ্গানুযায়ী প্রয়োগযোগ্যতা।
• জ্ঞান নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল : ২১শ শতকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী- জ্ঞান সবার জন্য একইভাবে সার্বজনীন নয়; এটি প্রসঙ্গ, সংস্কৃতি ও প্রয়োগের উপর নির্ভর করে। তাই জ্ঞান এখন আর নিরপেক্ষ নয় — এটি নির্ভর করে কে শিখছে, কোথায়, কেন, এবং কীভাবে প্রয়োগ করছে।
• প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান সর্বদা নিখাদ সত্য নয়ঃ বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) অনেক সময় "জ্ঞান" বোঝাতে শুধু কুরিকুলামে শেখানো বিষয়গুলো বোঝায়। কিন্তু আধুনিক দার্শনিক ও শিক্ষাবিদরা বলেন, "Institutional knowledge is constructed, partial, and sometimes power-influenced." যেমন, ঔপনিবেশিক ইতিহাসে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি বেশি প্রাধান্য পায়, যা একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ মাত্র।
• জ্ঞান মানে শুধু তথ্য জানা নয়; এর সাথে সঠিকভাবে কাজ করার দক্ষতা ও নৈতিকভাবে তা প্রয়োগ করার ক্ষমতাও জড়িত- আগে জ্ঞান মানে ছিল “তথ্য” বা “সত্য” জানানো। এখন জ্ঞান হলো: তথ্যের সাথে সমালোচনামূলক ভাবনা, বাস্তব জীবনে তার ব্যবহারযোগ্যতা এবং নৈতিকভাবে সঠিকভাবে তা বোঝার ও প্রয়োগ করার ক্ষমতার সমন্বয়। একজন প্রকৌশলীর জন্য তথ্য জানার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সেটা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারা এবং তার সামাজিক প্রভাব বোঝা।
• অনলাইন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও তথ্যজালের মাধ্যমে আদান-প্রদানযোগ্য আধুনিক জ্ঞানঃ ২১শ শতকে জ্ঞান শুধু বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এখন এটি: ক্লাউডে আছে, ইউটিউব ভিডিওতে আছে, গিটহাবে আছে, ব্লগ ও ওপেন সোর্সে আছে। তাই এখন একে বলা হয় “distributed knowledge” — যা সমাজ, প্রযুক্তি ও সহযোগিতার মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। এই ‘জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া’র’ ধারণাটি গ্রিক দর্শন এবং ইসলাম ধর্মেও আছে।
• জ্ঞান একটি নির্মাণ প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষার্থী নিজের অভিজ্ঞতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে জ্ঞান গঠন করেঃ আধুনিক শিক্ষায় বলা হয়: “শিক্ষার্থীরা জ্ঞান নির্মাণ করে, তারা শুধু তা গ্রহণ করে না।” এটি constructivism বা "নির্মাণবাদ" নামে পরিচিত। শিক্ষার্থী নিজের অভিজ্ঞতা, আগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান “গড়ে তোলে” ।
২১ শতকের শিক্ষার মূল ধারণা২১ শতকের শিক্ষার মূল ধারণাগুলি নিম্নরূপ-
• শিক্ষা কেবল তথ্য নয়, বরং দক্ষতা ও প্রয়োগযোগ্যতা। যেমন, আগে শিক্ষা মানেই ছিল তথ্য মুখস্থ করা ও পরীক্ষায় ভালো করা। ২১ শতকে শিক্ষা মানে, বিশ্লেষণ করা, সমস্যা সমাধান করা, নতুন কিছু উদ্ভাবন করা, এবং বাস্তবে তার প্রয়োগ করা।
• ডিজিটাল ও প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ শিক্ষা হল ই-লার্নিং, ভার্চুয়াল ক্লাস, AI, ব্লেন্ডেড লার্নিং ইত্যাদি এখন শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ। ছাত্ররা এখন গ্লোবাল রিসোর্স ব্যবহার করবে সেটাই কাম্য।
• সহযোগিতামূলক (Collaborative) ও আন্তঃনির্ভরশীল (Interdependent) শিক্ষা মানে হচ্ছে একক শেখার জায়গায় এখন দলভিত্তিক শেখা। গ্রুপ ও প্রকল্পভিত্তিক কাজ শেখায় পারস্পরিক সম্মান, মতামত, ও দলগত চিন্তা।
• সারাজীবনের শিক্ষা (Lifelong Learning) এর অর্থ হলো ২১শতকের চাকরির বাজার এবং ব্যবসা পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে তাই একজন ব্যক্তিকে বারবার নতুন স্কিল ও জ্ঞান অর্জন করতে হচ্ছে — শুধু ডিগ্রি দিয়ে জীবন চলবে না। সারাজীবনের শিক্ষার অংশ হিসেবে Volatility, Uncertainty, Complexity and Ambiguity(VUCA) analysis বা learning খুবই উপযুক্ত পাঠ্য। VUCA আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতি ও গতিশীলতাকে বর্ণনা করে, বিশেষ করে ব্যবসা, নেতৃত্ব এবং বৈশ্বিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এখন এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশ বিশ্লেষণের জন্য।
• নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও নাগরিক চেতনার শিক্ষা ২১ শতকের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। শুধু পেশাদার নয়, ভালো মানুষ তৈরিও ২১শতকের শিক্ষার লক্ষ্য। বর্তমানে শিক্ষায় নেতৃত্ব, মানবতা, পরিবেশ-সচেতনতা, নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক চেতনা গুরুত্ব পাচ্ছে। এগুলি শেখার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী দক্ষতাও অর্জন করে।
• উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল শিক্ষা (Innovation & Creativity) হচ্ছে সৃষ্টিশীল চিন্তা এবং নতুন পন্থায় সমস্যা সমাধান। শুধু বই নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা, ইন্টার্নশিপ, গবেষণা, ডিজাইন থিংকিং-এর মত কৌশল শিক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
• যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষা (Competency-based Learning) । এটি খুবই দরকারি একটা শিক্ষা ধারণা। গ্রেড বা সার্টিফিকেট নয়, শিক্ষার্থী কি বাস্তব জীবনে কাজ করতে পারছে — সেটাই এখন মূল বিবেচনা। সমস্যা সমাধান, যোগাযোগ দক্ষতা, টিমওয়ার্ক, আইটি স্কিল ইত্যাদি এখন "যোগ্যতা"র অংশ যা প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত হবে।
• বহুমাত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা (Multidimensional & Inclusive) এখন শুধু ধারণাই নয় এটি এখন বিশ্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে। লিঙ্গ, শ্রেণি, প্রতিবন্ধী, জাতিগত পরিচয় — সব পার্থক্য উপেক্ষা করে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। "একটি পদ্ধতি সবার জন্য" আর চলে না — এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক শেখা গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে জ্ঞান এবং শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ কেন Burning Issue?বিশ্ব এখন দ্রুত বদলাচ্ছে, কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো পুরোনো পদ্ধতিতে জ্ঞান প্রদান করে। ছাত্ররা অনেক কিছু মুখস্থ করছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ জানে না। শুধু সার্টিফিকেট ভিত্তিক জ্ঞান এখন যথেষ্ট নয়। চাকরি, উদ্যোক্তা, গবেষণা — সবখানেই বাস্তব দক্ষতা ও প্রয়োগযোগ্য জ্ঞান চাই। “Skill gap” বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ব্যবহারিক দক্ষতা বা problem-solving ability নেই। যেটা এখন চাকুরি বাজারে এবং কোম্পানিতে বিশেষভাবে প্রয়োজন। বাস্তবে অর্জিত জ্ঞানকে সমস্যা সমাধানে, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে, কাজের দক্ষতায় রূপান্তরিত করে প্রয়োগ করতে জানতে হবে এবং এটাই হল জ্ঞানের বাস্তব আর যৌক্তিক প্রয়োগ। জ্ঞানকে যৌক্তিকভাবে প্রয়োগের কথা কিন্তু প্লেটো প্রায় ২৪৫০ বছর আগে বলেছেন- কি আশ্চার্য জাদুকর দার্শনিক। এই সংমিশ্রণের মাধ্যমে একজন জ্ঞানী এবং শিক্ষিত ব্যক্তি শুধু মুখস্থ নয়, তার বোঝানোর সক্ষমতা বাড়ে, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, চাকরির জন্য প্রস্তুতি, সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা গড়ে উঠে এবং সমাজে বা প্রতিষ্ঠান বাস্তব সমাধান পায়।
বাংলাদেশে কী করা উচিত?বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষাদানের বাস্তবচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ২০ শতকের কাঠামোতেই আটকে আছে। ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতা সমন্বয়ে সমন্বিত পাঠদান এবং সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিকে সে ভাবে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতির বাস্তবচিত্র হলো মুখস্থনির্ভরতা অর্থাৎ পাঠ্যবই মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো ফল করা এখনও শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য। সৃজনশীল চিন্তা, বিশ্লেষণ, বাস্তব সমস্যার সমাধান করার অনুশীলন খুবই সীমিত। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা আরো বেশি ভয়াবহ। শিক্ষাদান মূলত পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য পরিচালিত হয়, জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনের জন্য নয়। শিক্ষার্থীরা GPA বা CGPA-র পেছনে ছুটে, কিন্তু বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত থাকে না।
সাথে আছে কারিগরি ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার ঘাটতি। সাধারণ শিক্ষা (জেনারেল স্টাডিজ) বেশি, কিন্তু কারিগরি (টেকনিক্যাল) ও পেশাভিত্তিক শিক্ষার পরিমাণ ও মান তুলনামূলক কম। শিল্পখাত ও কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণের অনেক অভাব। অনেক সময় সঠিক শিক্ষক নির্ণীত হয় না ফলে সঠিক শিক্ষককে সঠিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। অনেক শিক্ষকই আধুনিক পদ্ধতি বা ডিজিটাল শিক্ষায় প্রশিক্ষিত নন। পাঠদান এখনও একমুখী (One-way), যেখানে শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থী শুনে। প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই কম। শহরে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি ব্যবহার হলেও গ্রামীণ ও উপশহরগুলোতে তা প্রায় অনুপস্থিত। ফলে ডিজিটাল বিভাজন (digital divide) বাড়ছে। বাড়ছে রাজধানী বনাম মফস্বল শিক্ষার ব্যবধান।
শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতা—এই তিনটি কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং একে অপরকে পরিপূরক। আমাদের দেশে যদি শিক্ষাব্যবস্থা এই তিনটিকে আলাদাভাবে চর্চা করে, তবে শিক্ষার্থী পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত হতে পারে না। তাই এই উপাদানগুলোকে একত্রে গঠনমূলকভাবে পাঠ্যক্রমে একীভূত করা প্রয়োজন। বর্তমান পাঠদান পদ্ধতি এখনও অনেকাংশে নোটভিত্তিক, মুখস্থনির্ভর ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক। এই ধারা বদলে নির্মাণমূলক, শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক এবং সমস্যা-ভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীরা বাস্তব সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করবে, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক উদ্যোগ ইত্যাদি। তারা শিক্ষার্থী নিজেই প্রশ্ন করবে, তথ্য খুঁজবে এবং উপসংহার টানবে(inquiry based learing)। সব শিক্ষাই প্রযুক্তি এবং শ্রেণিকক্ষ-ভিত্তিক পাঠদানকে মিলিয়ে শেখার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একই সাথে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, এবং সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে পাঠ্যক্রমে মূল্যবোধ বিষয়ক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি করতে হবে। মনে রাখতে হবে নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা এক ধরনের অপূর্ণ শিক্ষা।
শিক্ষায়তনের কাঠামোগত ও দার্শনিক রূপান্তর করতে হবে। একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা শুধু পাঠ্যসূচি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির উপরও নির্ভর করে। তাই শিক্ষায়তনগুলোর মধ্যে গভীর দর্শনভিত্তিক পরিবর্তন আনতে হবে। এর জন্য কাঠামোগত পরিবর্তন যেমন আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষক তৈরি, যারা কেবল পাঠদান নয়, বরং মেন্টর বা গাইডের ভূমিকায় থাকবেন। কারিকুলাম সংস্কার করতে হবে। যদিও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কম বশী Outline Based Curriculum (OBE) চালু করেছে তবে এর প্রয়োগ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে করতে হবে। তথ্য মুখস্থ করার পরিবর্তে বিশ্লেষণ, প্রয়োগ ও সৃজনশীলতা ভিত্তিক কারিকুলাম হতে হবে। একই সাথে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে যেমন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ভার্চুয়াল এক্সপেরিমেন্ট, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার। শিক্ষা হতে হবে সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। যেমন প্রান্তিক ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের মূল ধারায় তুলে আনতে হবে। দার্শনিক ভিত্তিক শিক্ষা হবে জ্ঞান ও মানবিকতার সমন্বয় যার সাথে দেশের সংস্কৃতি ঘনিষ্ঠভাবে ভাবে জড়িত থাকবে।
পরিশেষেশিক্ষা, জ্ঞান এবং দক্ষতার পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও আন্তঃসম্পর্কিত। শিক্ষা জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া, যেখানে একজন শিক্ষার্থী নতুন ধারণা ও তথ্য অর্জন করে, এবং সেই জ্ঞানকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এজন্য, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান এর কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। তাই, শিক্ষা-কে শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবেই নয়, বরং দক্ষতা, সমস্যা সমাধান এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা উচিত। এটি নিশ্চিত করতে হলে, আমাদের শিক্ষার কাঠামোকে আরও প্রাসঙ্গিক এবং গঠনমূলক করে তুলতে হবে, যেন নতুন প্রজন্ম শুধু জ্ঞানী না হয়ে, বরং নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল এবং সমাজের উন্নয়নে সক্ষম ব্যক্তি হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা।
এইচআর/এএসএম