এখন সারাবছরই মশা নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও শুধু বর্ষাকালে মশার উপদ্রব বাড়তো। এখন শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামেও মশার কামড় থেকে বাঁচতে সবসময়ই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে মানুষ। এর মধ্যেই মশার কামড়ে প্রতিদিন অসুস্থ হচ্ছেন অনেকে। প্রায় প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ।
দেশজুড়ে এখন ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার বিস্তার। আছে চিকুনগুনিয়ার আতঙ্কও। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনগুলো নানান পদক্ষেপ নিলেও সফলতা একেবারেই কম। কীটতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, পদ্ধতিগতভাবে বছরজুড়ে জরিপ, গবেষণা ও যথাযথ পদক্ষেপ নিলে মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। যদিও এডিসের প্রজনন নিয়ে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় পূর্বাভাস দিলেও প্রতিরোধমূলক তেমন কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায় না।
আজ ২০ আগস্ট, বিশ্ব মশা দিবস। প্রতি বছর এ দিনটিতে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিবসটি। ১৮৯৭ সালের এ দিনে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার রোনাল্ড রস আবিষ্কার করেছিলেন যে, ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাজমোডিয়াম মশার মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। তার এ যুগান্তকারী আবিষ্কার মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে, যার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
শত্রু আমরা সবাই চিনি—মশা। এটি একসময় শহরে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। বরং শহরের বাইরেই এখন বেশি। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে মশা বাড়ছে। জমা পানিতে মশা ডিম পাড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করে।- অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
বিশ্ব মশা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য মশাবাহিত রোগ যেমন—ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ইয়েলো ফিভার, জাপানিজ এনসেফালাইটিস ইত্যাদি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং গবেষণা ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বারোপ করা।
আরও পড়ুন মশা মারতে ১৮৮ কোটি টাকা খরচ করবে ঢাকা উত্তর সিটিকরোনা ও ডেঙ্গুর সঙ্গে ভোগাচ্ছে চিকুনগুনিয়াওচলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১০০ ছুঁইছুঁইবাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, নগরায়ন ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। তাই শুধু একটি দিন নয়, সারাবছরই সরকার, গবেষক, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে কাজ করে সমন্বিতভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে।
শহর-গ্রামে মশার বিস্তার, জনসচেতনতা জরুরিদেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, শত্রু আমরা সবাই চিনি—মশা। এটি একসময় শহরে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। বরং শহরের বাইরেই এখন বেশি। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে মশা বাড়ছে। জমা পানিতে মশা ডিম পাড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করে।
‘এই মশা আপনার-আমার ঘরে আসে। ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টব, ছাদ ও বাসার চারপাশে যেখানে পানি জমে সেখানে মশা ডিম পাড়ে ও বংশবৃদ্ধি করে। পানি যেন কোথাও দুদিনের বেশি জমে না থাকে।’
মশার দেশ বাংলাদেশ। অথচ এখানেই মশা দিবস পালনে নেই তেমন উদ্যোগ। শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশা দমন সম্ভব নয়; এজন্য দরকার সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি।- অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার
তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল কাজ হলো—মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এটি প্রশাসনের একার দায়িত্ব নয়। যার যার ঘরবাড়ি, নিজেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘরের বাইরেও মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাস্তার ধারে, পরিত্যক্ত টায়ার, চিপসের প্যাকেটসহ নানান জায়গায় পানি জমে থাকে—এসব সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রশাসনকেও আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।’
‘জনগণকে খেয়াল রাখতে হবে, মশার কামড় থেকে নিজেকে যেন যতটা সম্ভব রক্ষা করা যায়। দিনে-রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। ছোট বাচ্চারা যেন হাফপ্যান্ট না পরে, ফুল প্যান্ট পরাতে হবে। মশার কামড় থেকে রক্ষা পেলে আমরা নিজেকে, পরিবারকে, সমাজ ও দেশকে রক্ষা করতে পারবো।’
এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সবাই খেয়াল রাখবেন—জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা ও গায়ে র্যাশ উঠলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সিরিয়াস হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। বাসায় থাকলে প্রচুর পানি, ডাব, ওরস্যালাইন, গ্লুকোজ, ফলমূলের রস খেতে হবে। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।’
সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবেকীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলছেন, ‘বিশ্ব মশা দিবস মূলত মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি, প্রতিরোধ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই পালিত হয়। মশা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ হিসেবে বিবেচ্য। প্রতিবছর কোটি কোটি মানুষ ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস, ইয়েলো ফিভার ও জাপানিজ এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুই বিশ্বব্যাপী শত শত মৃত্যুর জন্য দায়ী। মশার দেশ বাংলাদেশ। অথচ এখানেই মশা দিবস পালনে নেই তেমন উদ্যোগ।’
এডিস মশা দুটি ভাইরাসেরই বাহক হওয়ায়, একই সময়ে যে কেউ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। চিকুনগুনিয়া শনাক্তের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় জটিলতা হতে পারে চিকিৎসাতেও।- ডা. লেলিন চৌধুরী
‘শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে মশা দমন সম্ভব নয়; এজন্য দরকার সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি। মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এডিস মশা দুটি ভাইরাসেরই বাহক হওয়ায়, একই সময়ে যে কেউ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। চিকুনগুনিয়া শনাক্তের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় জটিলতা হতে পারে চিকিৎসাতেও।’
আরও পড়ুন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ, দায়ী জলবায়ু সংকটজ্বর হলেই ভয় লাগে, ডেঙ্গু-করোনার আতঙ্কেই হাসপাতালে আসছিমশা নিধনে দ্বিগুণ হারে কীটনাশক ছিটাবে ডিএসসিসিতিনি বলেন, ‘বছরের প্রথম থেকে কীটতত্ত্ববিদেরা এ বিষয়ে সতর্ক করলেও সরকারের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে মশা নিধনে কোনো ধরনের সমন্বিত কার্যক্রম দেখা যায়নি। যার ফলশ্রুতিতে এ বছর ডেঙ্গুরোগীর পাশাপাশি কয়েকগুণ হারে চিকুনগুনিয়াও বেড়ে চলেছে। আগে এটি শহরের সমস্যা হলেও এখন এটি গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনে গ্রাম থেকেও রোগী আসছে।’
জানতে চাইলে ডা. আয়শা আক্তার বলেন, ‘এই মৌসুমে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতা হয়। যার কারণে এডিস মশার জন্ম হয়। এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা—তিনটি রোগই হয়। এই বছর ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়াও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সেখানে জলাবদ্ধতা মূল দায়ী।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষার বাইরেও সারাবছর কিন্তু মশা থাকে। কারণ, ভরা মৌসুমেও পানি জমিয়ে রাখায় এডিস মশার জন্ম হয়। মশা থেকে আরও নানান ধরনের রোগ হচ্ছে। আমাদের দেশে সব এখনো আসেনি। মশা নানান রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসছে।’
‘একটি দিন সবাইকে সচেতন করার জন্য পালন করা হয়। কিন্তু প্রতিদিনই আমাদের সচেতন থাকতে হবে। মশার বংশবিস্তার রোধ করতে হবে’- পরামর্শ এ চিকিৎসকের।
এসইউজে/এমকেআর/জেআইএম