খেলাধুলা

সাইফের উপস্থিতিতেই বদলে গেল দলগত খেলার ধরন, ছড়ালো দ্যুতি

প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন, বাংলাদেশের জয় পেতে কষ্টই হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের চেয়ে দুর্বল-কমজোরি দলের বিপক্ষেও জেতে কষ্ট করে, অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

কিন্তু গতকাল শনিবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দেখা গেল ব্যতিক্রম ঘটনা। নেদারল্যান্ডসকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভাবছেন প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস, তাদের বিপক্ষে ৮ উইকেটের জয় নিয়েও এত উচ্ছ্বাস, প্রশংসা আর হৈচৈ কেন? হ্যাঁ, নেদারল্যান্ডস প্রতিপক্ষ হিসেবে দুর্বল। বাংলাদেশের তুলনায় আন্তর্জাতিক ম্যাচও অনেক কম খেলে, সাফল্যও কম। সর্বোপরি অভিজ্ঞতায়ও ডাচরা অনেক পিছিয়ে। কিন্তু পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, সব হিসেবে পিছিয়ে থাকা নেদারল্যান্ডসের সঙ্গেও বাংলাদেশের সে অর্থে দাপুটে জয় ও সাফল্য খুব কম।

ইতিহাস বলছে, আজকের আগে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ একবারই নেদারল্যান্ডসকে হেসেখেলে হারিয়েছিল। সেটা এক যুগেরও বেশি সময় আগে (২০১২ সালের ২৫ জুলাই জিম্বাবুয়ের হারারেতে)। ওই ম্যাচেও টাইগাররা জিতেছিল ৮ উইকেটে।

কাকতালীয়ভাবে সেই ম্যাচের স্কোরলাইনও ছিল অনেকটাই শনিবারের ম্যাচের মতো। জিততে বাংলাদেশের দরকার ছিল ১৪৫ রানের। তামিম ইকবালের ঝোড়ো অর্ধশতক (৫৩ বলে ৬৯*) ও মুশফিকুর রহিমের (২৪ বলে ৩৭*) আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ ৮ উইকেট হাতে রেখে জয়ের বন্দরে পৌঁছে গিয়েছিল ১২ বল আগে।

আর শনিবার ডাচদের করা ১৩৬ রান তাড়া করতে নেমে লিটন দাসের দল জিতেছে ৬ ওভারেরও আগে (৩৯ বল হাতে রেখে)।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের স্কোরলাইন বড় হয় কম, গড়পড়তা ১৪০ রান। যেখানে কম রানেই ইনিংস শেষ করার নজির বেশি টাইগারদের, সেখানে ডাচদের বিপক্ষে ৩৯ বল আগে ১৩৬ রান টপকে যাওয়া চোখে পড়ার মতো ঘটনা বৈকি। সে কারণেই বলা হয়েছে, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে এটাই সবচেয়ে দাপুটে জয় টাইগারদের।

ভাববেন না, সেটাই এই প্রতিবেদনের উপজীব্য। মূল বিষয় হলো, অনেকদিন পর হাত খুলে ব্যাটিংয়ের দারুণ দৃশ্য উপভোগ ও সেই দৃশ্যের বন্দনা।

ভাবছেন, সেটা বুঝি পাওয়ার হিটিং কোচ জুলিয়ান উডের হাতের ছোঁয়াতেই হয়েছে। তেমন ভাবাও পুরোপুরি ঠিক হবে না। কারণ, শনিবার চার নম্বরে নেমে ১৯ বলে ৩ ছক্কা ও এক চারে ৩৬ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলে দল জিতিয়ে সাজঘরে ফেরা সাইফ হাসান তো জুলিয়ান উডের ট্রেনিংই পাননি।

উড যখন ঢাকার শেরে বাংলা ও সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে পারভেজ হোসেন ইমন, তানজিদ তামিম, লিটন দাস, তাওহিদ হৃদয়দের জোরে মারা আর বড় শট নেওয়া শিখিয়েছেন, সাইফ হাসান তখন বাংলাদেশ ‘এ’ দলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায়। অর্থাৎ উডের কোচিং মূখ্য বিষয় নয়, আসল কথা হলো ক্রিকেটারদের আত্মনিবেদেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অ্যাপ্রোচ নিয়ে কথা হয় বিস্তর। আত্মনিবেদন নিয়েও উঠে প্রশ্ন। বলা হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মাঠে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার তাগিদ কম। কিন্তু শনিবার নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সবার মাঝেই তেড়ে ফুড়ে খেলার বাসনা চোখে পড়েছে। বোলিং-ফিল্ডিংয়ে সবার মধ্যেই উজাড় করে খেলার চেষ্টা দেখা গেছে।

ব্যাটিংয়েও অধিনায়ক লিটন দাস ও সাইফ হাসান রান চাকা সচল রাখার পাশাপাশি শটও খেলেছেন প্রচুর। স্কোরিং চান্স মিস করেননি কেউই। ঝুঁকিপূর্ণ শট, স্কুপ, রিভার্স সুইপ, স্লগ সুইপ খেলার বদলে উইকেটের সামনে বড় শট খেলতে চেষ্টা করেছেন দুজনই, সাফল্যও পেয়েছেন।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, অনেকদিন পর একাদশ সাজানোয়ও একটা পরিকল্পনার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। অভিজ্ঞ ও ইনফর্ম নুরুল হাসান সোহানকে বাইরে রেখে সাইফ হাসানকে অলরাউন্ডার কোটায় খেলানোর সিদ্ধান্তটা ছিল বড় ইতিবাচক দিক।

সাধারণত এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট দূরদর্শী সিদ্ধান্তের বদলে আবেগের বশে ভুল পথে হাঁটে। কিন্তু শনিবার টিম ম্যানেজমেন্টকে সঠিক পথেই দেখা গেল। তার কার্যকারিতাও মিলেছে। অলরাউন্ডার হিসেবে সুযোগ পেয়েই দারুণ প্রভাব ফেলেছেন সাইফ।

বাংলাদেশের ব্যাটারদের বেশির ভাগই উইকেটের সামনে বিগ শট খেলায় পাকা ও দক্ষ নন। অধিকাংশেরই টেনে অনসাইডে, বিশেষ করে ডিপ মিডউইকেট ও স্কয়ার লেগের আশপাশ দিয়ে তুলে মারার প্রবণতা বেশি।

সাইফ সেই জায়গায় ব্যতিক্রম। ঘরোয়া ক্রিকেটেও বহুবার তার প্রমাণ মিলেছে। পেস ও স্পিনে উইকেট থেকে এক দুই পা বেরিয়ে অফ ও অন সাইডে উইকেটের সামনে তুলে মারায় দক্ষ এই ব্যাটার নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে উইকেটের সামনে কয়েকটি সাহসী ও আস্থাপূর্ণ শট খেলে বল সীমানার ওপারে পাঠিয়েছেন।

আরও বড় কথা হচ্ছে, সাইফ হাসান আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ পেয়েছেন ২০ মাস পর। সর্বশেষ খেলেছিলেন এশিয়ান গেমসে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭ অক্টোবর।

দীর্ঘদিন পর দলে ফিরেই অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করার মানে হলো- আজকাল সাইফের বোলিং দক্ষতাও বেড়েছে। ‘এ’ দল ও রংপুর রাইডার্সের হয়ে গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি আসরে ব্যাট হাতে মোটামুটি সফল সাইফ গড়পড়তা এক দুটি উইকেট পাচ্ছিলেন প্রায়ই। শনিবারও বোলিংয়ে এসে দারুণ অফস্পিনে আউট করেছেন নেদারল্যান্ডসের দুই ব্যাটারকে।

একাদশে শেখ মেহেদী ছিলেন। আর মেহেদী হাসান মিরাজকে বাইরে রেখে সাইফকে নেওয়া হয়েছে অফস্পিনার কাম ব্যাটার হিসেবে। সুযোগ পেয়েই নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন সাইফ। সেটাই দল সাজানো ও খেলোয়াড় নির্বাচনে টিম ম্যানেজমেন্টের দূরদর্শিতার প্রমাণ।

সাইফ না খেললেও হয়তো বাংলাদেশ জিততো। কিন্তু শেখ মেহেদীর সঙ্গে অফস্পিনের সেকেন্ড অপশন সাইফের দুই উইকেট শিকার ও মিডল অর্ডারে তাওহিদ হৃদয়ের জায়গায় চারে নেমে ১৮৯.৪৭ স্ট্রাইকরেটে ৩৬ রানের ইনিংসে জয়টি সহজ হয়েছে বাংলাদেশের। টিম পারফরম্যান্সে দ্যুতিও ছড়িয়েছে।

এমন এক দুটি পরিবর্তন, পরিবর্ধনই কিন্তু দলের আত্মবিশ্বাস ও গতি বাড়িয়ে দেয়। যা টিম পারফরম্যান্সেরও পূর্বশর্ত।

এআরবি/এমএইচ/এমএস