সাহিত্য

জর্জ অরওয়েলের ‘বার্মিজ ডেইজ’

১৯০৩ সালের ২৫ জুন অর্থাৎ যে সময়টিতে জর্জ অরওয়েল অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন; তখন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যাহ্ন। নিয়েল ফার্গুসনের ভাষায় বলা যেতে পারে যে, ‘এডওয়ার্ডিয়ান যুগ ছিল নির্দিষ্ট শ্রেণির ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য মহান সমৃদ্ধির সময়। ব্রিটিশরা অনেক দেশ এবং জনগণের ওপর মালিকানার দখল গ্রহণ করে। একটি দেশ জয় করে তার মূল্যবান সম্পদ ও জমি কেড়ে নেওয়া এবং আদিবাসীদের খুব সস্তা, মানবেতর শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করার বিষয়টি সঠিক নাকি ভুল—এ রকম কোনো প্রশ্ন বেশিরভাগ ব্রিটিশদের মনেই উদয় হয়নি। বিপরীতে, বিশ্বজুড়ে ‘সভ্যতা’কে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাদেরই যেন একমাত্র দায় ছিল।’

অরওয়েল ১৯২১ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডের ইটন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরিবর্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অরওয়েলের বাবা রিচার্ড ব্লেয়ারও ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে সাব-ডেপুটি আফিম এজেন্ট হিসেবে চীনের আফিম ব্যবসার সহায়ক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অরওয়েলের ফরাসি বংশোদ্ভূত মা বার্মার মৌলমেইনে বড় হয়েছেন এবং তাঁর পরিবারের কতিপয় সদস্য তখনো সেখানে বাস করতেন।

১৯২২ সালের আগস্টে অরওয়েল ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের জন্য আবেদন করেন এবং পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে গৃহীত হন। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি বার্মার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর নতুন পদবি হয় প্রবেশনারি সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট এরিক ব্লেয়ার। পদায়নটি তাকে বার্মার উপনিবেশে এমন এক সময়ে এনে ফেলে; যখন বিশ্বব্যাপী অনেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক জনসাধারণ তাদের প্রতি চলমান শোষণের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। বার্মাও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

১৯২৬ সালের শেষের দিকে অরওয়েলকে বার্মার উঁচু অঞ্চল কাথা’য় নিযুক্ত করা হয়, এখানেই ১৯২৭ সালে তিনি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন। অসুস্থতার কারণে অর্জিত ছুটি নিয়ে সে বছর জুলাই মাসে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ইংল্যান্ডে ফেরার পর ১৯২৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকার সময় অরওয়েল তাঁর জীবনকে পুনর্মূল্যায়ন করেন। তিনি বার্মায় আর ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শৈশব থেকে অরওয়েল একজন লেখক হতে চেয়েছেন। তাই লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যেই ১৯২৮ সালের ১২ মার্চ তিনি ইম্পেরিয়াল পুলিশ বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি অনুধাবন করেন, বর্মিরা নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। তখন তিনি ঔপনিবেশিক পুলিশ অফিসার হিসেবে তাঁর ভূমিকার জন্য উত্তরোত্তর লজ্জা বোধ করেন। পরে তিনি তাঁর ‘বার্মিজ ডেইজ’ উপন্যাসে এবং ‘শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট’ এবং ‘আ হ্যাঙ্গিং’ শিরোনামের ব্যাখ্যামূলক রচনার ধ্রুপদী দুটি উজ্জ্বল আত্মজীবনীমূলক স্কেচে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার একজন রক্ষক এরিক আর্থার ব্লেয়ার থেকে তিনি সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহী জর্জ অরওয়েলে রূপান্তরিত হন।

১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘বার্মিজ ডেইজ’ ইংরেজ কথাসাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের প্রথম উপন্যাস এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ। সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু সময়ে ব্রিটিশ বার্মায় উপন্যাসের পটভূমিটি স্থাপন করা হয়েছে, ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবে যখন দিল্লি থেকে বার্মা শাসিত হতো। উপন্যাসটি ‘ব্রিটিশ রাজের অন্ধকার দিকের প্রতিকৃতি’ হিসেবে কাজ করে। উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে জন ফ্লোরি, ‘একটি বৃহত্তর ব্যবস্থার মধ্যে আটকা পড়া একাকী এবং অভাবী ব্যক্তি যা মানব প্রকৃতির উন্নত দিকটিকে ক্ষুন্ন করছে।’ উপন্যাসটি এমন একটি সমাজের ‘আদিবাসী দুর্নীতি এবং সাম্রাজ্যবাদী গোঁড়ামি উভয়ই’ বর্ণনা করে যেখানে, ‘সর্বোপরি, আদিবাসীরা আদিবাসী ছিল—নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় কিন্তু অবশেষে একধরনের নিকৃষ্ট মানুষ।’

জর্জ অরওয়েলের বার্মিজ ডেইজ গ্রন্থে ১৯২০-এর দশকের বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) বসবাসরত কতিপয় ইংরেজদের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। তারা বার্মায় যাপিত জীবনের তীব্র এবং অবর্ণনীয় একাকিত্ব দূর করার জন্য ইউরোপিয়ান ক্লাবে হুইস্কি পান করতে মিলিত হতেন। সে সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ বার্মার উঁচু অঞ্চলের কিউকতাদা জেলায় এ গল্পের শুরু। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফ্লোরি, ৩৫ বছর বয়সী একজন ইংরেজ কাঠ ব্যবসায়ী; যিনি বার্মায় তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবন কাটিয়েছেন। নিঃসঙ্গ ফ্লোরির একজন জীবনসঙ্গিনী খুঁজে বেড়ানোর গল্প এবং কিউকতাদা ইউরোপীয় ক্লাবে প্রথবারের মতো জনৈক ন্যাটিভ সদস্যের অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে উপন্যাসটি আলোকপাত করে। ফ্লোরির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তার মুখের বামপাশে একটি বড় অর্ধচন্দ্রাকৃতির জন্মদাগ। তিনি মাসের তিন সপ্তাহ জঙ্গল ক্যাম্পে অবস্থান করেন। তার সেই সময়টি কাটে ইংল্যান্ডে রপ্তানির জন্য সেগুনকাঠ সংগ্রহের তত্ত্বাবধান করার কাজে। বাকি সপ্তাহটা তিনি শহরে কাটান, যেখানে তার জীবন ইউরোপিয়ান ক্লাবকে কেন্দ্র করে।

ফ্লোরির প্রগতিশীল মতাদর্শ এবং বার্মিজ সংস্কৃতির প্রতি তার ভালোবাসার কারণে তিনি ক্লাবে একজন বহিরাগতের মতো চিহ্নিত হন। ক্লাবের সদস্যরা, বিশেষ করে উগ্র বর্ণবাদী এলিস তাকে উত্যক্ত করে। মা-হ্লা-মে নামে ফ্লোরির একজন বার্মিজ উপপত্নী থাকা সত্ত্বেও তিনি নিদারুণভাবে একাকিত্বে ভোগেন। তিনি একজন ইউরোপীয় স্ত্রীর অন্বেষণ করেন, যে তার মতো করে এদেশকে ভালোবাসবে এবং এহেন ভয়ংকর জীবন থেকে তাকে রক্ষা করবে। এখানে ফ্লোরির একমাত্র বন্ধু ভারতীয় শল্যচিকিৎসক ভেরাস্বামী, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে ফ্লোরি খোলামেলা নিজের সব কথা বলতে পারেন। তাদের কথোপকথনের সময় ফ্লোরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চুরির বাহন হিসেবে সমালোচনা করেন, যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে ক্রমশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফ্লোরির এই চেতনা সাম্রাজ্যের একজন কট্টর রক্ষক ভেরাস্বামীকেও আন্দোলিত করে। উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র, দুর্নীতিবাজ এবং চক্রান্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট ইউ পো কাইন। একজন ন্যাটিভ সদস্য নির্বাচন করার বিষয়ে ক্লাবের সিদ্ধান্ত জানতে পেয়ে সে নিজ স্বার্থরক্ষায় ডাক্তার ভেরাস্বামীর প্রতিপত্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র করে।

গল্পের মধ্যে মিস্টার এবং মিসেস ল্যাকারস্টিনের অনাথ ভাইঝি সুন্দরী তরুণী এলিজাবেথের আগমন ফ্লোরির একাকিত্ব দূর করে। তিনি মা-হ্লা-মে নামের তার উপপত্নীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। ঘটনাচক্রে এলিজাবেথকে একটি বুনো মহিষের কবল থেকে রক্ষা করার পর ফ্লোরি তাকে প্রণয় নিবেদন শুরু করেন। ফ্লোরির শিল্পের প্রতি বেশি ভালোবাসা এবং বার্মিজদের রটানো কুৎসা সত্ত্বেও এলিজাবেথ নিজের দারিদ্র্য এবং যৌন নিপীড়ক কাকার হাত থেকে রেহাই পেতে ফ্লোরির পূর্বরাগকে উপভোগ করে। ফ্লোরি বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাবেন এমন সময় এক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এর কিছুসময় পরেই উপন্যাসে ভেরাল নামের একজন সুদর্শন ও অভিজাত অশ্বারোহী সামরিক অফিসারের আগমন যেন ফ্লোরির সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেয়। এলিজাবেথ তখন ফ্লোরিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়ে ধনী এবং অহংকারী অফিসার ভেরালের বাহুলগ্না হয়।

ওদিকে, ম্যাজিস্ট্রেট ইউ পো কাইন ডাক্তার ভেরাস্বামীর বিরুদ্ধে তার অপপ্রচার অব্যাহত রাখে। কাইন ডাক্তারকে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে বেনামি চিঠি পাঠায়। কাইন একটি কৃত্রিম বিদ্রোহ সংগঠিত করে তা দমনের কৃতিত্ব নেয়। বিদ্রোহকালে বন কর্মকর্তা ম্যাক্সওয়েল জনৈক ন্যাটিভ বিদ্রোহীর পিঠে গুলি করে। এরপর দেখা যায়, ফ্লোরি ডাক্তার ভেরাস্বামীকে ক্লাবের সদস্যপদের জন্য সমর্থন করে। কিন্তু ভোটাভুটির সময় ন্যাটিভরা ম্যাক্সওয়েলের মৃতদেহ ক্লাবে নিয়ে আসে। প্রতিশোধপরায়ণ ন্যাটিভরা তাকে হত্যা করেছে। ম্যাক্সওয়েলের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উগ্র বর্ণবাদী এলিস জনৈক কিশোর নেটিভকে সহিংসভাবে আক্রমণ করে বসে। এভাবেই সূত্রপাত হয় কিউকতাদা বিদ্রোহের। বিদ্রোহের সময় বার্মিজ বিদ্রোহীরা ক্লাবকে অবরুদ্ধ করে ঘিরে রাখে এবং উগ্র বর্ণবাদী এলিসকে তাদের হাতে হস্তান্তরের দাবি জানায়। ফ্লোরি অস্বাভাবিক সাহসিকতা প্রদর্শন করে এবং স্বেচ্ছাসেবকদের পুলিশ লাইনে ঢুকতে নব উদ্যমে উৎসাহ জোগায়।

আরও পড়ুন কবি সুকান্তের সংক্ষিপ্ত অথচ অনন্ত জীবন  একটি জাতির জন্ম: প্রাসঙ্গিক আলোচনা 

এ ছাড়া, জেলা কমিশনার ম্যাকগ্রেগর পুলিশকে ন্যাটিভদের ভিড়ের মধ্যে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দেওয়ার পর ফ্লোরি এই নির্দেশের বিরোধিতা করেন। ফলে পুলিশ তাদের মাথার ওপর দিয়ে ফাঁকা গুলি চালায়। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ফ্লোরিকে একজন বীরের মর্যাদায় স্বাগত জানানো হয়। ফ্লোরির সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে ভেরাস্বামীর আত্মসম্মান রক্ষা হয়। ওদিকে ধনী অফিসার ভেরাল তখন এলিজাবেথকে পরিত্যাগ করে। এরপর এলিজাবেথ তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ফ্লোরির দিকে ফেরান। ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে বলে রাগান্বিত ইউ পো কাইন অন্য ইউরোপীয়দের কাছে ফ্লোরির সঙ্গে মা-হ্লা-মে নামের নারীর পূর্বতন ব্যাভিচারের কথা প্রচার করে বেড়ায়। এ ধরনের কুৎসা সম্পূর্ণরূপে ফ্লোরির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। এলিজাবেথ তাকে জানায়, সে তাকে কখনো বিয়ে করবে না বরং মৃত্যু অথবা চির কুমারিত্ব বেছে নেবে। জীবনের আর কোনো মূল্য অবশিষ্ট নেই ভেবে ফ্লোরি বাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি তখন তার প্রিয় কুকুরটিকে হত্যা করেন এবং তারপরে নিজেকেও আত্মহননের পথে নিয়ে যান।

ফ্লোরির চিরপ্রস্থানের পর ভেরাস্বামীকে পদচ্যুত করা হয় এবং দূরের অন্য এক হাসপাতালে বদলি করা হয়। ইউ পো কাইন ঔপনিবেশিক প্রশাসন দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ক্লাবে যোগদান করে। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে ইউ পো কাইন প্যাগোডা নির্মাণে অর্থায়নের মাধ্যমে তার কর্মফল খণ্ডনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু শুরু করার আগেই তিনি অপোলেক্সিতে মারা যান। এলিজাবেথ নিস্ব হাতে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। অতঃপর ম্যাকগ্রেগরের অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব গ্রহণ করে এলিজাবেথ তার বাকি জীবন আরামে কাটায়। স্থানীয় অধিবাসীরা তাকে ভয় পায় এবং তার প্রতি দারুণ অবজ্ঞার চোখে তাকায়।

বার্মিজ ডেইজ প্রথম প্রকাশিত হয় সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ আশঙ্কা করা হয় যে, এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য মানহানিকর হতে পারে। উপন্যাসের কিউকতাদা শহরটি মূলত রূপক হলেও জর্জ অরওয়েলের এককালের চাকরিস্থল প্রাদেশিক শহর কাথার খুব বাস্তবসম্মত বর্ণনা। উপন্যাসের কিছু কাল্পনিক চরিত্র শনাক্তযোগ্য ব্যক্তিদের ওপর খুব ঘনিষ্ঠভাবে ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। পরিবর্তিত নামসহ একটি ব্রিটিশ সংস্করণ এক বছর পর প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালের এক চিঠিতে অরওয়েল লিখেছেন, ‘আমি সাহস করে বলতে পারি যে, উপন্যাসের কাহিনিটি কিছু দিক থেকে অন্যায্য এবং কিছু বিবরণে ভুল থাকলেও এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি তা বর্ণনা করেছি।’

অরওয়েল ১৯২২ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর বার্মায় (বর্তমানে মায়ানমার) ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশ বাহিনীতে পুলিশ অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ব্রিটিশরা কয়েকটি ধাপে ধীরে ধীরে বার্মাকে নিজেদের সাথে সংযুক্ত করে নিয়েছিল। ১৮৮৫ সালে তারা রাজকীয় রাজধানী মান্দালয় দখল করার পর সমগ্র বার্মাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা সম্ভব হয়। ভারত ও চীন থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরা ছিল স্থানীয় বার্মিজ জনগোষ্ঠীর পরিপূরক। যদিও ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল, তবুও বেশিরভাগ সম্পদই ছিল ইউরোপীয়দের হাতে। উপনিবেশ হিসেবে বার্মাকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া হিসেবে দেখা হতো। ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে বার্মার স্থানীয় জনগণ সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের একেবারে নিচের দিকে ছিল। সেখানকার ভারতীয়, চীনা এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের সামাজিক প্রতিপত্তির অবস্থান ছিল মধ্যম এবং ইউরোপীয়দের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে।

এই সম্প্রদায়সমূহে ব্রিটিশদের যে ভাবমূর্তি বজায় রাখার কথা ছিল তা ছিল এক বিরাট চাপের। ইংরেজরা তাদের নিজস্ব রীতিনীতি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এসব সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করতো। রপ্তানি পণ্যসমূহের মধ্যে বার্মার পাহাড়ি জঙ্গলসমূহে সারাবিশ্বের ৭৫ শতাংশ সেগুনকাঠ উৎপাদিত হতো। ১৯২৪ সালের জানুয়ারিতে যখন জর্জ অরওয়েল (এরিক আর্থার ব্লেয়ার) সাম্রাজ্যবাদী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করতে ইরাবতী ব-দ্বীপে আসেন; তখন ব-দ্বীপটি ছিল বার্মার শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক অঞ্চল। বার্ষিক তিন মিলিয়ন টন চাল সরবরাহ করতো, যা ছিল বিশ্বের মোট সরবরাহের অর্ধেক। অরওয়েল বার্মার বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করেন। মান্দালয় এবং মায়মিওতে এক বছরের সামরিক প্রশিক্ষণের পর তার কর্মস্থল ছিল বার্মাজুড়ে যথাক্রমে মায়াংম্যা, টোয়ানতে, সিরিয়াম, মৌলমেইন এবং কাথা নামের একটি শহরে। এর মধ্যে রেঙ্গুনের উত্তরে অবস্থিত ইনসেইনও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইনসেইন ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের সবচেয়ে নিরাপদ কারাগার এবং বর্তমানে মায়ানমারের সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার।

‘বার্মিজ ডেইজ’ উপন্যাস নির্মাণে অরওয়েল বেশ কয়েক বছর সময় নিয়েছেন। অরওয়েল ১৯২৮ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত প্যারিসে এটির খসড়া তৈরি করেন। ১৯৩২ সালে সাউথওল্ডে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় পারিবারিক বাড়ি গোছানোর সময় তিনি এটি সংশোধন করেন। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি চূড়ান্ত সংস্করণটি টাইপ করেন এবং ১৯৩৪ সালে পাণ্ডুলিপিটি তার সাহিত্য প্রতিনিধি লিওনার্দ মুরের কাছে হস্তান্তর করেন। লিওনার্দ মুরে পাণ্ডুলিপিটি অরওয়েলের পূর্ববর্তী গ্রন্থের প্রকাশক ভিক্টর গোলানকজের কাছে জমা দেন। গোলানকজ এরই মধ্যে অরওয়েলের অন্য একটি উপন্যাস প্রকাশের কারণে বিচারের ভয়ে, মানহানির অভিযোগের বিষয়ে শঙ্কিত থাকায় বার্মিজ ডেইজের পাণ্ডুলিপিটি ফিরিয়ে দেন।

ওদিকে বিখ্যাত ও সুপরিচিত দুই ব্রিটিশ প্রকাশনা সংস্থা হাইনম্যান এবং জোনাথন কেপ উভয়েই একই কারণে পাণ্ডুলিপিটি প্রত্যাখ্যান করে। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হাইনম্যান সাহিত্য ও শিক্ষামূলক উপকরণ প্রকাশে সুনাম অর্জন করে, অন্যদিকে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত জোনাথন কেপ তার সাহিত্যিক কল্পকাহিনি এবং আকর্ষণীয় বইয়ের নকশার জন্য সুপরিচিত ছিল। উভয় সংস্থাই প্রকাশনা জগতে প্রভাবশালী ছিল, বিশেষ করে হাইনম্যান তার আফ্রিকান রাইটার্স সিরিজের জন্য ছিল সুবিদিত। এরপর হার্পার অ্যান্ড ব্রাদার্স উপন্যাসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশ করতে রাজি হয়। এরপর সেখান থেকেই ১৯৩৪ সালে ‘বার্মিজ ডেইজ’ প্রকাশিত হয়।

১৯৩৫ সালের বসন্তকালে প্রকাশক ভিক্টর গোলানকজ ঘোষণা করেন যে, তারা একটি ব্রিটিশ সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রস্তুত। তবে অরওয়েলকে প্রমাণ করতে হবে যে, উপন্যাসে তিনি প্রকৃত লোকদের নাম উল্লেখ করেননি। সেই লক্ষ্যে ১৯৩৫ সালের ২৪ জুন গোলানকজ ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে কিন্তু তার আগে ঔপনিবেশিক তালিকাসমূহ ঘেটে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। তা সত্ত্বেও উপন্যাসে প্রদর্শিত অনেক প্রধান ইউরোপীয় নামই তখনকার রেঙ্গুন গেজেটে প্রকৃত মানুষের নাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশেষ করে ‘ইউ পো কাইন’ নামটি একজন বার্মিজ অফিসারের নাম, যিনি অরওয়েলের সাথে মান্দালয়ের পুলিশ প্রশিক্ষণ স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

এসইউ/জিকেএস