টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে নেপাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভের ঢেউ। দুর্বল শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের হতাশা থেকেই শুরু হয়েছিল আন্দোলন, কিন্তু এখন তা রূপ নিয়েছে পূর্ণাঙ্গ ‘জেন-জি’ বিক্ষোভে। লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে দেশের তথাকথিত নেপো কিডরা অর্থাৎ, ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের সুবিধাভোগী সন্তানরা। দেশটির সিংহভাগ তরুণের অভিযোগ, নেপো কিডরা চরম বিলাসিতায় জীবন কাটালেই সাধারণ মানুষকে লড়াই করতে হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে।
বিক্ষোভের শুরু
প্রথমদিকে দুর্নীতি ও সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও দ্রুত তা বিস্তৃত হয়ে যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াইয়ে। হাজারো তরুণ রাস্তায় নেমে জবাবদিহি ও পরিবর্তনের দাবি তোলে।
বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৩১ জন নিহত ও এক হাজারের বেশি আহত হয়েছে। আগুনে পুড়েছে সংসদ ভবন, সরকারি কার্যালয়, শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত বাড়ি এমনকি পর্যটক আকর্ষণীয় হোটেলগুলোও। সংসদ ভবন ধ্বংস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং নেপাল এখন রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত।
অনেক তরুণের কাছে এই বিক্ষোভ কেবল নেতৃত্ব ব্যর্থতার বিরুদ্ধে নয়, এটি প্রজন্মের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। যখন সাধারণ পরিবারগুলো দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে, তখন রাজনীতিবিদদের সন্তানরা বিলাসবহুল গাড়ি চালায়, দামী ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাক প্রদর্শন করে এবং বিদেশ ভ্রমণের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখায়।
কারা এই নেপো কিড?
তরুণ কর্মীরা অভিযোগ করছেন, রাজনীতিবিদদের সন্তানরা জনগণের টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। তারা প্রভাব খাটিয়ে পদ-অবস্থান দখল করে, যোগ্যতা ছাড়াই সুযোগ পাচ্ছে এবং জবাবদিহির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
শিভানা শ্রেষ্ঠা
নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার পুত্রবধূ শিভানা শ্রেষ্ঠা এই বিতর্কের অন্যতম প্রতীক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার প্রদর্শন তাকে বিশেষ আলোচনায় এনেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, তার নামে কোটি কোটি রুপির সম্পত্তি রয়েছে, অথচ সাধারণ নেপালি নাগরিকেরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে।
সৌগত থাপা
সাবেক আইনমন্ত্রী বিন্দু কুমার থাপার ছেলে সৌগত থাপার নামও ঘুরে বেড়াচ্ছে বিতর্কের কেন্দ্রে। বাণিজ্য পরিষদের নির্বাচনে তার জয় অনেকের কাছে পারিবারিক প্রভাবের ফল, যোগ্যতার নয়। তরুণ বিক্ষোভকারীরা বলছেন, অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি বিলাসবহুল গাড়ি, বিদেশি শিক্ষা আর ধনী ব্যবসায়ীর মতো জীবনযাপনের সুযোগ পাচ্ছেন কেবল রাজনৈতিক বংশধর হওয়ার কারণে।
বিনা মাগার
নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল প্রচণ্ড’র পুত্রবধূ বিনা মাগারও বিক্ষোভকারীদের আক্রমণের মুখে পড়েছেন। সাবেক পানি সরবরাহ মন্ত্রী হিসেবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি সরকারি অর্থ বিদেশ ভ্রমণে খরচ করেছেন ও গ্রামীণ পানিসম্পদ প্রকল্পের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন।
শৃঙ্খলা খাতিওয়াদা
মিস নেপাল ওয়ার্ল্ড খেতাব জয়ী শৃঙ্খল খাতিওয়াদা অভিযুক্ত হয়েছেন তার বাবা, সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী বিরোধ খাঁতিওয়াড়ার রাজনৈতিক প্রভাব থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে। মাত্র ২৯ বছর বয়সেই তার বিলাসবহুল জীবন ও ঝলমলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপস্থিতি তাকে সমালোচনা ফেলেছে। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তিনি প্রায় এক লাখ ইনস্টাগ্রাম অনুসারী হারিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
কেন ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম?
তরুণ নেপালিদের কাছে এই লড়াই ন্যায্যতার দাবি। যখন তথাকথিত নেপো কিডরা সম্পদের প্রদর্শন করছে, তখন অধিকাংশ তরুণ বেকার, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়ছে এবং অনেকেই কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। বৈষম্য এতটাই প্রকট যে তা বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় নেপাল এশিয়ার অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে ৭১ মিলিয়ন ডলারের জালিয়াতি কিংবা শরণার্থী কোটার কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা তরুণদের আস্থা নষ্ট করেছে। কিন্তু মামলার রায় কিংবা শাস্তি খুবই বিরল, যা তরুণদের কাছে এই ধারণাকে পোক্ত করেছে যে রাজনৈতিক অভিজাত ও তাদের নেপো কিডরা আইনের ঊর্ধ্বে।
নেপালের জেন-জি আন্দোলন কেবল সরকার বদলের দাবি নয়। এটি সমতার দাবি, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার দাবি এবং পারিবারিক রাজনৈতিক সুবিধাভোগের অবসানের দাবি। অনেকেই মনে করছেন, এই আন্দোলন নেপালের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে ও অবশেষে দেশকে নেপো কিডদের লাগামহীন বিলাসবহুল জীবনযাত্রার মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে।
সূত্র: ইন্ডিয়া টাইমস
এসএএইচ