পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা রাতের বেলায় যেন রূপ নেয় এক অন্যরকম শহরে। পুরোনো ঔপনিবেশিক ভবনগুলো, রাজবাড়ি, মন্দির, গির্জা আর বাজার—সবই এখন আলোর ছোঁয়ায় জেগে উঠছে নতুন প্রাণে। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই বলছেন, কলকাতা রাতের বেলায় যেন প্যারিসের মতো ঝলমল করে।
এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে কলকাতা ইলুমিনেশন প্রজেক্ট, যা পরিচালিত হচ্ছে একেবারেই নাগরিক উদ্যোগে। প্রকল্পটি চালাচ্ছেন ব্যবসায়ী ও কলকাতা প্রেমিক মুদার পাঠেরিয়া, যিনি একদল বন্ধু ও পরিচিতজনদের অনুদানে এই কাজ শুরু করেছিলেন।
তিনি বলেন, এটা কোনো সংস্থা নয়—না আছে কোনো সভাপতি, না কমিটি। আমরা শুধু একটিমাত্র হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য বড়।
প্রকল্পের শুরুটা হয়েছিল একটি পুরোনো মার্কেট ভবনের গম্বুজে রং করার ইচ্ছা থেকে। পরে দেখা যায়, দিনের আলোয় সেই সৌন্দর্য দেখা গেলেও রাতে তা হারিয়ে যায়। এরপরই সিদ্ধান্ত হয় আলোকসজ্জার, যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে।
গত ২১ মাসে এরই মধ্যে ৯২টি ভবন আলোকিত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক রাজ ভবন, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, হগ মার্কেট, বিভিন্ন গির্জা, মন্দির ও চত্বর।
মুদার বলেন, মডেলটা সহজ: তোমার ভবন, আমার আলো। তুমি শুধু বিদ্যুৎ বিল দাও, সেটাও আমি আগেই হিসাব করে জানিয়ে দিই।
তবে আলোকসজ্জার সঙ্গে আরও একটি চ্যালেঞ্জ সামনে আসে—ভবনগুলোর জরাজীর্ণ দশা। আলোর নিচে পরিষ্কার দেখা যায় ফাটল, ধসে পড়া অংশ আর নষ্ট ঘড়িগুলো। ফলে দরকার পড়ে সংস্কার ও পুনরুদ্ধার।
উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত হগ মার্কেটের ঘড়িঘর, যা একসময় প্রতি ১৫ মিনিট পরপর বিভিন্ন সুরে বাজতো, এখন দীর্ঘদিন ধরে নীরব। সেই ঘড়ি সারানোর দায়িত্ব নিয়েছেন শহরের একমাত্র চতুর্থ প্রজন্মের ঘড়ি মিস্ত্রি স্বপন দত্ত ওরফে ‘ঘড়ি-বাবু’, যিনি এরই মধ্যে এক ডজনেরও বেশি পুরোনো ঘড়ি মেরামত করেছেন।
এটি শুধু এক ধরনের শহর আলোকসজ্জা প্রকল্প নয়। কলকাতা রিস্টোরারস-এর মূল উদ্দেশ্য হলো শহরের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও গর্ব ফিরিয়ে আনা।
লেখিকা হিমানজলি শঙ্কর বলেন, আমরা অনেক সময়ই শুনি কলকাতা পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু এসব আলো দেখিয়ে দেয়, কেউ কেউ এখনো শহরটাকে ভালোবাসে ও তার ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে চায়।
যেখানে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে শহরের পুরোনো ঐতিহ্য অনেক সময় ‘অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা’ বলে বাতিল করা হয়, সেখানে মুদার পাঠেরিয়া প্রমাণ করেছেন, সাধারণ মানুষও ঐতিহ্য সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিতে পারে।
কলকাতা বাই নাইট ট্যুরে দাঁড়িয়ে পাঠেরিয়া ইশারা করেন এক গোটা রাস্তার দিকে, যেখানে সব ভবনই এখন আলোকিত। আমার লক্ষ্য ২০০টি ভবন আলোকিত করা। তাহলেই কলকাতা হবে দেশের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর রাতের শহরগুলোর একটি।
সূত্র: বিবিসি
এমএসএম