জাতীয়

শুরুতে শেষ ন্যানো প্রযুক্তিতে কৃষি-শিল্প-স্বাস্থ্যে এগোনোর স্বপ্ন

• অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত• রাষ্ট্রের গচ্চা ২ কোটি টাকা• বাধা পড়লো দেশেই উন্নত গবেষণায়

পরমাণু কৌশল কাজে লাগিয়ে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। এখন সামনে আসছে ন্যানো প্রযুক্তি। কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের কথা মাথায় রেখে একটি ন্যানো টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও এগোনোর স্বপ্ন শুরুতেই যেন শেষ।

ন্যানো প্রযুক্তি বর্তমানে শুধু গবেষণার বিষয় নয়, বরং ভূমি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, শক্তি, খাদ্য, শিল্পসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এসব খাতে বিপ্লব আনতে পারে ন্যানো প্রযুক্তি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ব্যাপকভাবে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্পেও বড় পরিবর্তন আনতে পারে এ প্রযুক্তি।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব খাতের উন্নয়নে ‘ইনস্টিটউট অব ন্যানো টেকনোলজি স্থাপন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ১ জুলাই। সাভারে দুই একর জমিও নির্বাচন করা হয়। প্রকল্পের টাকা খরচ করে সাইট সিলেকশন, মাটি পরীক্ষা, মাটির উপরিভাগ পরীক্ষা, আর্কিটেকচার ডিজাইন, ইলেকট্রনিক ডিজাইন, সিভিল ডিজাইন, প্লাম্বিংসহ করা হয় নানান কাজ। এসবসহ শুরু থেকে প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বেতন ও অফিস খরচ বাবদ এরই মধ্যে দুই কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এত টাকা খরচের পরে বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে প্রকল্পটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘ইনস্টিটউট অব ন্যানো টেকনোলজি স্থাপন’ প্রকল্প নিয়ে চলতি বছরের ২০ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. কাইয়ুম আরা বেগমের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। সভায় প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকি শুধু বন্ধের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকল্পটি বন্ধের জন্য তেমন কোনো যৌক্তিক কারণও দেখাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত হতে যাওয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমজাতীয় অন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কোনো দ্বৈততা আছে কি না এবং প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়েছে কি না সে সব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের পরিচালক ড. শামশাদ বেগম চৌধুরী।

প্রকল্পের যৌক্তিকতা ছিল কি না এটা দেখতে হবে। যদি যৌক্তিকতা থাকে তবে এটা চালু রাখা উচিত। কারণ মনে রাখতে হবে দুই কোটি টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের বেনিফিট কী তা দেখতে হবে। ভালো হলে বন্ধ করার যৌক্তিকতা দেখছি না।- অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি

এই কমিটি জানায়, ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) বিদ্যমান প্রস্তাবসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত হতে যাওয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমজাতীয় অন্য গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের দ্বৈততা নেই। সার্বিক বিবেচনায় প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়েছে।

   

আরও পড়ুন

স্মার্ট কৃষিকে সক্ষম করবে যেসব প্রযুক্তি

কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, কম খরচে লাভ বেশি স্মার্ট হেলথ সিস্টেমে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অবদান রয়েছে

ওই সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন মো. মোকাব্বির হোসেন। দুই কোটি টাকা খরচের পর প্রকল্প বন্ধ করার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. মোকাব্বির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ওই (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) মন্ত্রণালয়ে এখন আর নেই। বর্তমানে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কাজ করছি। সুতরাং, ওই মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে মন্তব্য করার এখতিয়ার আমার নেই।’

প্রকল্পের উদ্দেশ্য

প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৮০ কোটি ৭৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা। বাস্তবায়ন মেয়াদ ১ জুলাই ২০২৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য একটি পূর্ণাঙ্গ ন্যানো টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন, ন্যানো ম্যাটেরিয়াল প্রস্তুতের আধুনিক সুবিধা সম্বলিত যন্ত্রপাতি স্থাপন, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ন্যানো টেকনোলজিতে দক্ষ জনবল তৈরি, যাতে চিকিৎসা, কৃষি ও বস্ত্রশিল্পে ন্যানো প্রযুক্তির বাস্তবমুখী ব্যবহার নিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে প্রকল্পের অনুকূলে ১২ কোটি ১২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ৫২ লাখ টাকা অবমুক্তির সরকারি আদেশ জারি করা হয়েছে এবং ব্যয় করা হয়েছে ২৮ লাখ ৫ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছর ভৌত অগ্রগতি ১৫ শতাংশ। এছাড়া ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ০ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন জানায়, একটি দল দীর্ঘদিন ধরে ন্যানো টেকনোলজির ওপর সীমিত পরিসরে ফলপ্রসূ গবেষণা করে আসছে। এ বিষয়ে তাদের গবেষণালদ্ধ ফলাফল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে তিন শতাধিক প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয় এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সেমিনার, কর্মশালা বা সম্মেলনে নিয়মিত উপস্থাপিত হচ্ছে। বিষয়গুলো বিবেচনা করে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো শিল্প, স্বাস্থ্য, কৃষি, গ্রিন এনার্জি, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সাশ্রয় এবং উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে একটি পূর্ণাঙ্গ ন্যানো টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

ন্যানো টেকনোলজি দেশের জন্য দরকার। এটা আমরা চালু রাখবো। এটা চালু রাখতে ইক্যুইপমেন্ট রিসার্চ দরকার। তবে চলমান প্রকল্পটির নকশায় সমস্যা আছে।- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন

কমিশনের সিদ্ধান্তক্রমে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি রিপোর্ট আশানুরূপ হওয়ায় এবং বিভিন্ন সেবাগ্রহীতা বা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার উদ্যেগ নেয়। বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ন্যানো টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপিত হলে শিল্প, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ স্টেকহোল্ডার হিসেবে দেশের অন্য গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও উপকৃত হবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা ন্যানো টেকনোলজি

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায়, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প, খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশ খাতে ন্যানো প্রযুক্তির প্রয়োগের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের কৃষিখাতে ন্যানো-সার, ন্যানো-পেস্টিসাইড, স্মার্ট ডেলিভারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, খরচ কমানো এবং টেকসই কৃষি নিশ্চিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান খাত টেক্সটাইলেও ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। একইভাবে পানি পরিশোধন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ও টেকসই শিল্পায়নে ন্যানো প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী যেমন ব্যবহৃত হচ্ছে, বাংলাদেশেও এর প্রয়োজনীয়তা ক্রমবর্ধমান। স্বাস্থ্যখাতের জন্যও ন্যানো প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি মানসম্পন্ন ইনস্টিটিউট গড়ে তুললে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখানেই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা এবং নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

সাভারের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অত্যাধুনিক একটি ন্যানো টেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশে ন্যানো প্রযুক্তির উন্নয়ন হবে এবং শিল্প, কৃষি, টেক্সটাইল, পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা, শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া দেশে ন্যানো টেকনোলজিনির্ভর পণ্যগুলোর আমদানিনির্ভরতা কমাবে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি ন্যানো টেকনোলজিভিত্তিক বিভিন্ন পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত বাড়বে।

যা বলছেন অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের যৌক্তিকতা ছিল কি না এটা দেখতে হবে। যদি যৌক্তিকতা থাকে তবে এটা চালু রাখা উচিত। কারণ মনে রাখতে হবে দুই কোটি টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের বেনিফিট কী তা দেখতে হবে। ভালো হলে বন্ধ করার যৌক্তিকতা দেখছি না। ’

প্রকল্পটি বন্ধের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরেননি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মজিবুর রহমান।

তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ন্যানো টেকনোলজি দেশের জন্য দরকার। এটা আমরা চালু রাখবো। এটা চালু রাখতে ইক্যুইপমেন্ট রিসার্চ দরকার। তবে চলমান প্রকল্পটির নকশায় সমস্যা আছে।’

এমওএস/এএসএ/এমএফএ/এমএস