ইসলামের শেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, তোমরা কবর জিয়ারত কর, কারণ কবর মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কবর জিয়ারত করা বলতে আমরা মানে মুসলিমরা বুঝি, কবরে যাওয়া ও কবরবাসীর জন্য দোয়া করাকে। সেই অর্থে নিংসিয়ায় অবস্থিত সিসিয়া বা পশ্চিমাঞ্চলীয় সিয়া রাজবংশ আমলের রাজকীয় কবরস্থান পরিদর্শনকে ঠিক ‘জিয়ারত’ বলা হয়তো যাবে না, কিন্তু প্রাচীনকালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা-রাণীদের কবরের ধ্বংসাবশেষ দেখে যথারীতি আমার প্রথমে মৃত্যুর কথাই মনে হয়েছে। আমি কবর দেখতে দেখতে সহকর্মী শিশিরকে বললাম, ‘এটাই হচ্ছে জীবন। এই রাজকীয় কবরগুলো যাদের, তাঁরাও একসময় এই পৃথিবীতে চলাফেরা করেছেন, আনন্দ-বেদনার কাব্য রচনা করেছেন; আজ তাঁরা ইতিহাস। আমরাও একসময় থাকব না। এই রাজা-রাণীদের কবরের ধ্বংসাবশেষ তো তাও টিকে আছে, আমাদের সেটাও থাকবে না।’ শিশির মাথা নেড়ে আমার কথায় সায় দিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
৮ আগস্ট ছিল চীনের নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী ইনছুয়ানে আমাদের চতুর্থ দিন। সকাল থেকেই বৃষ্টি। আমার প্রিয় বর্ষাকাল। চীনে বর্ষাকাল বলে কিছু নেই, তবে বৃষ্টিপাত ঠিকই হয়। কখনও কখনও সমুদ্রের কোথাও নিম্নচাপ দেখা দিলে, টানা কয়েক দিনও বৃষ্টি পড়ে। তবে, সেটা বেইজিংয়ে বা অন্য কোথাও, নিংসিয়াতে নয়। নিংসিয়ায় বৃষ্টিপাত খুবই কম হয়। এখানে, গোবি মরুভূমির প্রভাবে, রাত ও দিনের তাপমাত্রায়ও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়। আর এ কারণেই নাকি এখানে উৎপন্ন হয় বিশ্বের সেরা ‘কৌছি বেরি’ বা উলফবেরি (wolfberry)।
বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের সকালের কার্যক্রম শুরু হয়। সকালে আমরা দুটি জায়গা বা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করি। এর মধ্যে একটা প্রতিষ্ঠানের সদরদপ্তরের শীর্ষে বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা আছে Wolfberry। প্রতিষ্ঠানটির নাম নিংসিয়া উফুপাইরুই উলফবেরি ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি লিমিটেড। আর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম স্মার্ট প্যালেস ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল কমিউনিকেশন গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। আমরা প্রথমে এই প্রতিষ্ঠানটিই পরিদর্শন করি।
উলফবেরি কোম্পানি
স্মার্ট প্যালেস প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। এর কার্যক্রম ২২টি আরব দেশে বিস্তৃত। এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল, চীনা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে অন্য ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে, চীনা জ্ঞান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি ১৬ শতাধিক চীনা গ্রন্থ ও সাহিত্য প্রায় এক ডজন ভাষায় অনুবাদ করেছে। তবে, সবকিছু দেখেশুনে মনে হলো, স্মার্ট প্যালেস চীনা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করার ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
আরবিভাষীদের চীনা ভাষা শেখানোর জন্য তাঁরা আধুনিক নানান প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। আমরা একটা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমও দেখলাম সেখানে। আছে চীনা ভাষা শেখানোর জন্য আরবি ভাষায় লেখা টেক্সট বইও। আরবি-চীনা-আরবি অভিধানও প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি; একটি ‘স্মার্ট চায়নিজ লার্নিং অ্যাপ’-ও ডেভেলপ করেছে, যা আরব বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়।
শুধু চীনা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করে বা আরবিভাষীদের চীনা ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি স্মার্ট প্যালেস; আরবি সাহিত্যকেও চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছে। ইতোমধ্যেই ছোটদের ও বড়দের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের বই আরবি থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তবে, এতোসব অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে, স্বাভাবিকভাবেই, একটি গ্রন্থ আমার দৃষ্টি বেশি আকর্ষণ করে, আর সেটি হচ্ছে, ইসলামের শেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনী। স্মার্ট প্যালেস আরবি থেকে গ্রন্থটি চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছে। চীনা ভাষায় অনূদিত নবিচরিত দেখে আমার মনে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করলো।
তবে, শুধু চীনা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করে বা আরবিভাষীদের চীনা ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি স্মার্ট প্যালেস; আরবি সাহিত্যকেও চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ করছে। ইতোমধ্যেই ছোটদের ও বড়দের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের বই আরবি থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তবে, এতোসব অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে, স্বাভাবিকভাবেই, একটি গ্রন্থ আমার দৃষ্টি বেশি আকর্ষণ করে, আর সেটি হচ্ছে, ইসলামের শেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনী। স্মার্ট প্যালেস আরবি থেকে গ্রন্থটি চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছে। চীনা ভাষায় অনূদিত নবিচরিত দেখে আমার মনে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করলো।
সিসিয়া রাজকীয় সমাধি যাদুঘরের সামনে লেখক
এই ভালো লাগা নিয়েই রওয়ানা হলাম পরবর্তী গন্তব্য নিংসিয়া উফুপাইরুই উলফবেরি ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি লিমিটেডের পথে। আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। বৃষ্টিস্নাত উলফবেরি ভবনটি দেখে ভালো লাগলো। এ প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে ১৯৯৮ সালে। এর মধ্যেই এর মূলধন প্রায় সাড়ে আট কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির বৈশিষ্ট্য, এটি একটি কমপ্লিট প্যাকেজ। এটি কৌছি বেরি বা উলফবেরি চাষ করে (এর নিজস্ব আবাদি জমির পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরের বেশি), কৌছি বেরি নিয়ে গবেষণা করে ও নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করে, এবং সেসব পণ্য দেশে-বিদেশে বিক্রি করে। তাদের পণ্যের মধ্যে আছে: শুকনো কৌছি বেরি ফল, কৌছি বেরির কনসেনট্রেটেড পাল্প, কৌছি বেরি জ্যুস, কৌছি বেরির বীজ থেকে তৈরি তেল, কৌছি বেরির পাওডার, এমনকি, কৌছি বেরি থেকে তৈরি কারি পাওডারও! আরও বিভিন্ন ধরনের পণ্য থরে থরে সাজানো আছে প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কেন্দ্রে, যেটি মূল ভবনের ভিতরেই অবস্থিত। এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও জাপানসহ ২৭টি দেশে রফতানি হয়। কোম্পানির একজন কর্মকর্তা আমাদের জানালেন, আগামী অক্টোবর মাসে বাংলাদেশেও তাদের পণ্য পাওয়া যাবে।
চীনে একটা কথা প্রচলিত আছে: বিশ্বের সেরা উলফবেরি উৎপন্ন হয় চীনে, আর চীনের সবচেয়ে ভালো উলফবেরি উৎপন্ন হয় নিংসিয়ায়। আগেই বলেছি, নিংসিয়ার অনন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যই, এখানে উৎপাদিত কৌছি বেরি বিশ্বসেরা। নিংসিয়ায় কৌছি বেরি চাষ হচ্ছে ৫ শতাধিক বছর ধরে। মিং রাজবংশ আমলে নিংসিয়ার কৌছি বেরিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। শুনেছি, একমাত্র নিংসিয়ায় উৎপাদিত কৌছি বেরিরই ওষধি গুণাবলি রয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই, চীনে রান্নায় কৌছি বেরির ব্যবহার এন্তার।
বাংলাদেশে নিংসিয়ার কৌছি বেরি ও কৌছি বেরিজাত পণ্য কি জনপ্রিয় হবে? এটা ছিল শিশিরের প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার জন্য সহজ নয়। একটা পণ্যকে জনপ্রিয় করতে পণ্যের মান ও স্বাদ নিশ্চিত করতে হবে এবং এর উপকারিতা-সম্পর্কিত তথ্যাদির ওপর ভোক্তাদের মনে আস্থা সৃষ্টি হতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমি এরই মধ্যে কৌছি বেরির জুস খেয়েছি, কৌছি বেরি দিয়ে তৈরি একধরনের নরম কেক খেয়েছি, আমার ভালো লেগেছে। আমার ধারণা, দাম যদি আকাশছোঁয়া না-হয়, ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে থাকে, তবে বাংলাদেশে নিংসিয়ার কৌছি বেরি থেকে তৈরি বিভিন্ন পণ্য, বিশেষ করে জুস জনপ্রিয়তা পাবে। কিন্তু, মান ঠিক রেখে, দাম বাংলাদেশি ভোক্তাদের নাগালের মধ্যে রাখা হবে কোম্পানির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদেরকে অবশ্য পয়সা দিয়ে জুস কিনে খেতে হয়নি; কোম্পানি অতিথি হিসেবে ফ্রিতেই জুস পান করতে দিয়েছে। কয়েক পদের জুস; কোনোটা মিষ্টি, কোনোটা টক-মিষ্টি, আবার কোনোটা টক। আমি যখন তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিংসিয়ার কৌছি বেরির ফ্রি জুসের স্বাদ নিচ্ছি, ঠিক তখনই নিংসিয়া ডেইলির সুন্দরী সাংবাদিক এসে হানা দিলেন। ইন্টারভিউ চাই। ফ্রি জুস খেতে খেতে ফ্রিতে ইন্টারভিউ দিলাম। আর, জুসের স্বাদ এক বিদেশির কাছে ভালো লেগেছে জেনে, সাংবাদিক মেয়েটি আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিলেন।
সিসিয়া রাজকীয় সমাধি
হোটেলের রুমের সাথে ব্রেকফাস্ট ফ্রি। সকালে বের হওয়ার সময় সেই ফ্রি ব্রেকফাস্ট করিনি। এখন নিংসিয়ার কৌছি বেরির জুস খেয়ে আমার বাঙালি পেটে ভাতের ক্ষুধার উদ্রেগ হলো। ভাগ্য ভালো, দিনের কার্যসূচিতে এর পরেই ছিল লাঞ্চ। সমস্যা হচ্ছে, শিডিউল টাইট। লাঞ্চের পরে রেস্টের সময় নেই, ছুটতে হবে পশ্চিমাঞ্চলীয় সিয়া রাজবংশের সমাধিসৌধ দেখতে। লাঞ্চশেষে তাই বাসে চেপে আমরা পৌঁছালাম ইনছুয়ানের সিসিয়া জেলায়, যেখানে সমাধিসৌধের পাশাপাশি, সমাধিসৌধ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় সিয়া রাজবংশ-সম্পর্কিত একটি যাদুঘরও আছে। আমরা প্রথমে জাদুঘরে গেলাম। যথারীতি অনেক ভিড়। গরমের ছুটিতে চীনজুড়ে অসংখ্য যাদুঘরে এমন ভিড় স্বাভাবিক।
জাদুঘরে স্থান পেয়েছে দশ সহস্রাধিক পুরাকীর্তি। সমাধিসৌধ এলাকা খননের সময় এসব পুরাকীর্তি পাওয়া যায়। যাই হোক, জাদুঘর পরিদর্শনশেষে আমরা বাসে চেপে গেলাম মূল সমাধিসৌধে। ৫ হেক্টর এলাকাজুড়ে, হ্যলান পর্বতের পাদদেশে, এই রাজকীয় সমাধিস্থল। গোটা এলাকায় আছে ৯টি রাজকীয় সমাধিসৌধ। এগুলো রাজা-রাণীদের কবর। পুরো এলাকাজুড়ে আরও আছে ২৭১টি সাধারণ কবর। ধারণা করা হয়, এগুলো রাজবংশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের।
বলছি রাজকীয় সমাধিসৌধ, কিন্তু প্রথম দর্শনে এগুলোকে মাটির উঁচু ঢিবি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাধিগুলোর আকৃতি আগে প্যাগোডার মতো ছিল। কিন্তু কালের আবর্তে সেগুলো সৌন্দর্য হারিয়েছে, টিকে আছে ধ্বংসাবশেষ হয়ে। এখানে একটু বলে রাখি, পশ্চিমাঞ্চলীয় সিয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১০৩৮ সালে। তাংসিয়াং নামক এক জাতি এ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। সে রাজ্যে তাংসিয়াং জাতির মানুষের পাশাপাশি, হান, তিব্বতি ও উইগুর জনগোষ্ঠীও বাস করতো। তখন চীনের মূল অংশে সুং রাজার শাসন কায়েম ছিল। পাশাপাশি, আরও দু’একটা স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল আজকের চীনের তৎকালীন ভূভাগে। সিয়া রাজবংশের সাথে বাকি সব রাজবংশের ভালো সম্পর্কও ছিল। পশ্চিমাঞ্চলীয় সিয়া রাজ্যের আয়তন ছিল আজকের নিংসিয়ার প্রায় ১৭ গুণ (নিংসিয়ার আয়তন ৬৬, ৪০০ বর্গকিলোমিটার)। বোঝা যায়, দোর্দন্ড প্রতাপশালী ছিলেন সিয়া রাজারা। কিন্তু তাদের শাসন টিকে ছিল মাত্র ১৯০ বছর। ১২২৭ সালে মঙ্গোলদের হামলায় পতন ঘটে পশ্চিমাঞ্চলীয় সিয়া রাজবংশের; নিহত হন ওই রাজবংশের শেষ রাজা; শুরু হয় নিংসিয়া ও এর আশেপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত সিয়া রাজ্যে মঙ্গোল শাসন। সে অন্য এক ইতিহাস। (চলবে)ইনছুয়ান, নিংসিয়া, চীন
লেখক : বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com
এইচআর/এমএস