পর্যটনে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ যেন অপরিসীম সম্ভাবনার এক উপেক্ষিত গল্প। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও অপার জীববৈচিত্র্য নিয়েও এই রেঞ্জে পর্যটকের আগমন নগণ্য। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি ও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হলেও এখানে পর্যটন বিকাশে বাধা আন্তর্জাতিক মানের আবাসন, নিরাপদ জলযান, নিরাপত্তা শঙ্কা। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সরকারি নীতি ও বেসরকারি বিনিয়োগ পেলে এই অঞ্চল থেকে শত কোটি টাকার রাজস্ব আয় সম্ভব, যা বৈশ্বিক পর্যটনে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে।
পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর সুন্দরবনে প্রায় ২ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জে আসেন মাত্র ১৫-২০ হাজার, যা মোট পর্যটকের ১০ শতাংশেরও কম। অথচ এই অঞ্চলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, বানর, অসংখ্য প্রজাতির পাখি, নদী-খাল, মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত এবং পুটনির দ্বীপসহ বহু প্রাকৃতিক আকর্ষণ রয়েছে। স্থানীয় লোকসংস্কৃতি, বনজীবী ও জেলেদের জীবনযাপন, মধু, মাছ, কাঁকড়াসহ নানা খাবার পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ হতে পারতো।
পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ করা গেলে শুধু সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকেই বছরে শত কোটি টাকার রাজস্ব আয় সম্ভব।
‘বিশ্ব পর্যটন দিবসে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। এখানে রয়েছে অপরিসীম সম্ভাবনা, কিন্তু বাস্তবে সীমাহীন সংকট। সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ ও পরিবেশ সংরক্ষণ একসঙ্গে হলে এই অঞ্চল শুধু বাংলাদেশের নয় বরং বৈশ্বিক পর্যটনের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।’
কিন্তু বাস্তবতা হতাশাজনক। সাতক্ষীরায় কোনো আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-মোটেল বা রিসোর্ট নেই। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় আবাসিক ও ভালো মানের খাবারের হোটেলও সীমিত। ‘বরসা’ ও ‘টাইগার পয়েন্ট’ নামে দুটি বেসরকারি রিসোর্ট এবং জেলা পরিষদের একটি ডাকবাংলো ও ‘আকাশনীলা’ নামে একটি সরকারি রেস্ট হাউস থাকলেও এগুলোর কক্ষ সংখ্যা কম এবং রক্ষণাবেক্ষণ দুর্বল। ফলে পর্যটকরা দীর্ঘসময় অবস্থান করতে চান না। সাতক্ষীরা জেলা শহরে কিছু সাধারণ মানের হোটেল থাকলেও তা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখতে যথেষ্ট নয়।
একইভাবে সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আধুনিক ও নিরাপদ জলযান নেই। পর্যটকদের বেশিরভাগই বাধ্য হয়ে স্থানীয় ট্রলার বা ছোট নৌকায় ভ্রমণ করেন, যা একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ আবার আরামদায়কও নয়। এজন্য পরিবার নিয়ে অনেকে এই রুটে ভ্রমণ করতে অনিচ্ছুক। তার ওপর সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর পর্যন্ত সড়কের বেহাল দশা পর্যটন খাতকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আরও পড়ুন:সেন্টমার্টিনে এখনো গত মৌসুমের হতাশার ছাপ
টেকসই পর্যটনের নতুন দিগন্ত টি-ট্যুরিজম
এছাড়া সাতক্ষীরার পর্যটনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাও বড় বাধা। সরকার ২০১৮ সালে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করলেও পর্যটকদের মনে এখনো আতঙ্ক রয়ে গেছে। দীর্ঘদিন বনদস্যুদের তাণ্ডব এই অঞ্চলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পাশাপাশি পর্যটকদের আকর্ষণ কমছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে। বন বিভাগের ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, সমগ্র সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১২৫টি। একসময় হাজার হাজার চিত্রা হরিণ দেখা গেলেও চোরাশিকারিদের তাণ্ডবে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। চোরাশিকার, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ধ্বংস এই সংকটকে আরও বাড়াচ্ছে।
‘এখন প্রয়োজন একটি স্পষ্ট নীতিমালা, যেখানে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও অনুমোদনের নিশ্চয়তা থাকবে। সরকার যদি পর্যটন খাতে কর সুবিধা দেয় ও প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ করে, তাহলে সাতক্ষীরা রেঞ্জ অচিরেই দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।’
এছাড়া পরিবেশগত বিপর্যয়ও বড় হুমকি। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্পানসহ একের পর এক দুর্যোগ সুন্দরবনকে বিপর্যস্ত করেছে। বেড়েছে লবণাক্ততা, শুকিয়ে যাচ্ছে গাছ, ভরাট হচ্ছে নদী-খাল। ফলে বনভূমির সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। অথচ এই বনকে ঘিরেই জীবিকা নির্বাহ করেন লাখো মানুষ, জেলে, মধু সংগ্রাহক, গোলপাতা কাটাসহ নানা পেশায় নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হলে এদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ ন ম গাউছার রেজা বলেন, ‘সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক ঐতিহ্য। সাতক্ষীরায় পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারি নীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ একসঙ্গে জরুরি।’
সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সিগঞ্জের পরিবেশকর্মী মো. ফজলু হোসেন বলেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস হলে পর্যটন টিকবে না। তাই বনের গাছ রক্ষা, নদী খনন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অপরিহার্য।’
‘আমি মনে করি, সরকার, বেসরকারি খাত ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগই সুন্দরবনের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে পারে। সাতক্ষীরার সুন্দরবন রেঞ্জে যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।’
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলেন, জেলায় পর্যটনের মান বৃদ্ধিতে নীতিগত দিক থেকে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, প্রথমত, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। নিরাপদ ও আধুনিক জলযান চালু করা প্রয়োজন। বন ও জলপথে নিরাপত্তা জোরদার করে পর্যটকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাঘ, হরিণ, কুমিরসহ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কঠোর আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। স্থানীয় মানুষকে পর্যটনের সরাসরি অংশীদার করতে হবে। কমিউনিটি ট্যুরিজম চালু করা গেলে দারিদ্র্য কমবে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব হবে। পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিত করতে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ, গাছ কাটা বন্ধ এবং পুনরায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নিতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুন্দরবনের পর্যটন প্রচারে ট্রাভেল ফেয়ার, ডকুমেন্টারি ও ডিজিটাল প্রচারণা বাড়াতে হবে।
আরও পড়ুন:নতুন সংকটে বান্দরবানের পর্যটন শিল্প
যাতায়াত দুর্ভোগে ৪০ শতাংশ পর্যটক কমেছে সিলেটে
সাতক্ষীরা সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক গাজী সালাউদ্দিন বাপ্পী বলেন, ‘বিশ্ব পর্যটন দিবসে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। এখানে রয়েছে অপরিসীম সম্ভাবনা, কিন্তু বাস্তবে সীমাহীন সংকট। সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ ও পরিবেশ সংরক্ষণ একসঙ্গে হলে এই অঞ্চল শুধু বাংলাদেশের নয় বরং বৈশ্বিক পর্যটনের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে। সুন্দরবন আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই আজকের অঙ্গীকার হোক, আমরা এই অমূল্য সম্পদকে রক্ষা করবো, সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবো ও বিশ্বকে জানাব, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অদ্বিতীয়।’
স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী পলাশ বলেন, ‘সাতক্ষীরায় পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের আগ্রহ অনেক। আমরা চাই সুন্দরবন ঘিরে আধুনিক রিসোর্ট, মানসম্মত রেস্টুরেন্ট, নিরাপদ ও আরামদায়ক নৌযান চালু করতে। এতে শুধু দেশি নয়, বিদেশি পর্যটকরাও আকৃষ্ট হবেন ও কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা একের পর এক বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। বিশেষ করে ব্যাংক ঋণ পাওয়া অত্যন্ত জটিল। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও অনুমোদন নিতে মাসের পর মাস দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। তাছাড়া অনুমোদনের ক্ষেত্রে জটিলতা উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে। এসব সমস্যা সমাধান করা গেলে অনেকেই পর্যটন খাতে বড় বিনিয়োগ করতে রাজি হবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন প্রয়োজন একটি স্পষ্ট নীতিমালা, যেখানে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও অনুমোদনের নিশ্চয়তা থাকবে। সরকার যদি পর্যটন খাতে কর সুবিধা দেয় ও প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ করে, তাহলে সাতক্ষীরা রেঞ্জ অচিরেই দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।’
এ বিষয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক ফজলুল হক বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট হলো পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব। অবকাঠামো উন্নয়ন, বন ও জলপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, দর্শনার্থীদের জন্য আধুনিক সুবিধা, এসব খাতেই অর্থের তীব্র ঘাটতি রয়েছে। তারপরও পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে শুধু সরকারি বরাদ্দ নয়, বেসরকারি বিনিয়োগও জরুরি। বর্তমানে আমাদের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর আধুনিক ট্রেল নির্মাণ হয়েছে। পর্যটকদের জন্য ওয়াশরুম, বিশ্রামাগার নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। ফলে পর্যটকেরা উৎসাহিত হচ্ছেন। এছাড়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়ানো ও স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। এজন্য সরকারি পর্যায়ে বড় বাজেট বরাদ্দ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, সরকার, বেসরকারি খাত ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগই সুন্দরবনের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে পারে। সাতক্ষীরার সুন্দরবন রেঞ্জে যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।’
এমএন/জেআইএম