স্বাস্থ্য

মেরুরজ্জুর আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য নেই পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন কাঠামো

বাংলাদেশে প্রতি বছর শত শত মানুষ মেরুরজ্জু বা স্পাইনাল কর্ডে আঘাতের কারণে স্থায়ীভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হচ্ছেন। উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া, ভারী জিনিস বহনকালে বা সড়ক দুর্ঘটনায় পাওয়া এ আঘাত শুধু শারীরিকভাবে অক্ষমই করে দেয় না, বরং আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে ফেলে দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক প্রান্তিককরণ এবং মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে।

দেশে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও প্রতিবন্ধী অধিকার আইন থাকলেও এখন পর্যন্ত মেরুরজ্জুর আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য কোনো বিশেষায়িত সরকারি নীতি, প্রোটোকল বা পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসায় বিলম্ব, দক্ষ জনবলের অভাব এবং পুনর্বাসন সুবিধার সীমাবদ্ধতায় আক্রান্তরা প্রতিনিয়ত প্রতিরোধযোগ্য জটিলতার শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশে মেরুরজ্জুর আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছে। এটি ২৯ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। সিবিএম গ্লোবাল ডিজ্যাবিলিটি ইনক্লুসনের সহযোগিতায় পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় এ গবেষণার ফলাফল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সমর্থন আদায়ের জন্য ব্যবহার হবে।

গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা

গবেষণায় বলা হয়, মেরুরজ্জুর আঘাত কেবল শারীরিক অক্ষমতাই নয়; বরং মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের অধিকাংশ আঘাতের ঘটনা ঘটে পুরুষদের ক্ষেত্রে- বিশেষত উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া, ভারী মালামাল বহনজনিত দুর্ঘটনা এবং সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। এর ফলে পরিবার ও সমাজ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যদিও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এবং প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ বিদ্যমান, তবে এখনো পর্যন্ত মেরুরজ্জুর আঘাত বিষয়ে কোনো জাতীয় নীতি, প্রোটোকল বা পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন কাঠামো নেই। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অপ্রতিরোধযোগ্য জটিলতা, সামাজিক বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক প্রান্তিককরণের শিকার হচ্ছেন।

গবেষণার কাঠামো ও অংশগ্রহণ

মোট ৫২৫ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ছিলেন নীতিনির্ধারক, প্রশাসক, রোগ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসাধীন রোগী এবং পুনর্বাসন শেষে সমাজে ফিরে যাওয়া ব্যক্তি। এসডব্লিউওটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ এবং তৃতীয় স্তরের হাসপাতালগুলোতে মেরুরজ্জুর আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাস্তবতা খতিয়ে দেখা হয়।

সক্ষমতা: কোথায় কত অগ্রগতি

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার কিছু ইতিবাচক সক্ষমতা রয়েছে। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে জরুরি তাৎক্ষণিক চিকিৎসা তুলনামূলক সহজলভ্য। সব বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে সিটি স্ক্যান সুবিধা রয়েছে এবং ৮৫.৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এমআরআই করা সম্ভব।

জেলা হাসপাতালের মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশে উভয় সুবিধা আছে। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একেবারেই নেই। কিছু প্রতিষ্ঠানে স্পাইনাল সার্জন, অর্থোপেডিক সার্জন এবং ফিজিয়াট্রিস্টের সেবা পাওয়া যায়। এ সক্ষমতাগুলো নির্দেশ করে, বিদ্যমান অবকাঠামো ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে কৌশলগতভাবে উন্নয়ন ঘটালে স্তরভিত্তিক মেরুরজ্জুর আঘাত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব।

দুর্বলতা: সীমাবদ্ধ সেবা ও ঘাটতি

সীমাবদ্ধতার তালিকা অনেক দীর্ঘ। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থা নেই, ফলে প্রাথমিক চিকিৎসায় বিলম্ব হয়। ৯০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য প্রশাসক বলেছেন, প্রয়োজনীয় পেশাজীবী যেমন ফিজিয়াট্রিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট ও পুনর্বাসন নার্সের অভাব মারাত্মক।

মেরুরজ্জুর আঘাতপ্রাপ্তদের কোনো জাতীয় রেজিস্ট্রি বা ডেটাবেস নেই। চাপজনিত ঘা, মূত্রনালী সংক্রমণ, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এবং পেশীর অস্থিরতার মতো জটিলতা মোকাবিলায় কোনো কাঠামোবদ্ধব্যবস্থা নেই। নারী রোগীর অন্তর্ভুক্তি খুবই কম এবং তৃতীয় লিঙ্গের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।

করণীয়: মডেল কেন্দ্র ও পেশাজীবী অন্তর্ভুক্তি

গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে- সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে অন্তত একটি মডেল সরকারি মেরুরজ্জুর আঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন। উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বিত কৌশল গ্রহণ। ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, প্রোস্টেটিস্ট, অর্থোটিস্ট এবং স্পিচ থেরাপিস্টসহ পুনর্বাসন পেশাজীবীদের সরকারি স্বাস্থ্যখাতে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্তি। ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ এবং সব স্তরে কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

সিআরপির গবেষণা মতে, সমন্বিত উদ্যোগ, যথাযথ বিনিয়োগ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল নেওয়া গেলে বাংলাদেশে মেরুরজ্জুর আঘাত সেবাকে একটি সমতা ও স্থিতিশীলতার মডেল হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে হাজারো পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবার মর্যাদা, স্বনির্ভরতা এবং উৎপাদনশীলতা ফিরে পেতে পারে।

এসইউজে/একিউএফ/জেআইএম