ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স প্রদানে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সেই তথ্যই পাওয়া গেছে পৌরসভার লাইসেন্সের তালিকায়। পৌরসভা থেকে তিন হাজার লাইসেন্স দেওয়া হলেও কেউ একাই পেয়েছেন অর্ধশতাধিক, আবার কেউ একটিও পাননি। আবার অনেকে চড়া দামে ভাড়া বা বিক্রি করেছেন তাদের লাইসেন্স।
রিকশা শ্রমিকদের দাবি, চালকদের লাইসেন্স প্রদান না করে অনিয়মের মাধ্যমে মালিকদের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে।
দেড়শো বছরের পুরোনো ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পৌরবাসীর এখন গলার কাঁটা। শহরের প্রধান সড়কে যানজটের প্রধান কারণ এই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। বিগত সরকারের সময় ২০২০-২১ অর্থবছরে তিন হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স প্রদান করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা। এসব লাইসেন্স প্রদানে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দলীয়করণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সম্প্রতি জাগো নিউজের তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের প্রেক্ষিতে পাওয়া যায় এই অটোরিকশার লাইসেন্স প্রাপ্তদের তালিকা। তালিকা অনুযায়ী কেউ পেয়েছেন অর্ধশতাধিক লাইসেন্স, আবার রিকশার প্রকৃত মালিক হয়েও কেউ পাননি একটি লাইসেন্স।
অধিকাংশ লাইসেন্সই পেয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার। এরমধ্যে পশ্চিম মেড্ডায় ৪২৯, ৪৩১ ও ৪৩৩নং হোল্ডিংয়ের সেন ও দত্ত পরিবারকে দেওয়া হয়েছে শতাধিক লাইসেন্স, উত্তর পৈরতলার শফিকুর রহমান হুসেনের পরিবার পেয়েছে ৫৬টি, একই এলাকার ইয়াছিন মিয়ার পরিবার ৫৬টি, অলিউর রহমানের পরিবার ৪৬টি, হাফিজ মিয়া ৪২টি, শেরপুরের মহসিন আহমেদকে ৪০টি, একই এলাকার মাহবুবুর রহমান ২৬টি, পাইকপাড়ার বেগম মিয়ার নামে ২৪টি, ছয়বাড়িয়ার জামাল মিয়ার পরিবার ৩২টি, দাতিয়ারার তাইফুর রহমান পাপন ২৬টিসহ আরও অনেকে ২০-৩০টি করে লাইসেন্স নিয়েছেন। এছাড়াও শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন খান আশা নিয়েছেন ১৫টি ও আরেক শ্রমিকলীগ নেতা দুলাল মিয়ার পরিবার নিয়েছেন ৪০টি লাইসেন্স।
আরও পড়ুনমনপুরার চরাঞ্চলে শিক্ষক সংকটে চলছে না পাঠদান পদ্মা সেতুর সুবাদে মোংলায় গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির নতুন দিগন্ত পেঁয়াজ চাষে হতাশা বাড়াচ্ছে সার ‘সিন্ডিকেট’
পৌরসভার বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে সুহিলপুর ইউনিয়নের ঘাটুরার আলী আকবরের পরিবারকে ৪৪টি, নাটাই গ্রামের ইলিয়াছকে ২০টি ও একই এলাকার আপন মিয়াকে ৮টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এসব লাইসেন্স দেওয়ার পর সমালোচনার মুখে পৌরসভা লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে তা হয়ে যায় সোনার হরিণ। এরইমধ্যে অনেকেই লাইসেন্স পেয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন চড়ে মূল্যে। একেকটি লাইসেন্স বিক্রি করেন ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকায়। পাশাপাশি এসব লাইসেন্স নকল করে রিকশায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে পৌরসভা থেকে তিন হাজার লাইসেন্স প্রদান করলেও শহরে রিকশা চলছে অন্তত ১০-১৫ হাজার।
এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ শ্রমিক শ্রমিক সংগঠনগুলো। কিছুদিন পর পর শ্রমিক সংগঠনগুলো লাইসেন্স পেতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাদের দাবি, শ্রমিকদের লাইসেন্স না দিয়ে মালিকদের লাইসেন্স প্রদান করায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এসব লাইসেন্স পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ ঘরানার লোকজন। শ্রমিক লীগ নেতাদের নিয়ে এসব লাইসেন্স বণ্টন করেছেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আল মামুন সরকার।
শহরের সরকারপাড়ার হৃদয় মিয়া নামের এক রিকশা চালক বলেন, আমার একটি রিকশা রয়েছে। এটি আমি নিজেই চালাই। অথচ আমার রিকশার একটা লাইসেন্স পাইনি। কয়েকদিন পর পর আমাকে ট্রাফিক পুলিশ আটক করে রিকশা নিয়ে যায়। তখন ২৬০০ টাকা জরিমানা দিয়ে নিয়ে আসতে হয়। রিকশা চালিয়ে এসব টাকা দিব নাকি নিজের সংসার চালাবো?
শরিফ মিয়া নামে আরেক চালক বলেন, বড়লোক ব্যবসায়ীদের এসব লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। অনেকে আবার লাইসেন্স পাওয়ার পর পৌরসভা থেকে বন্ধ করে দেওয়ায় তা লাখ টাকায় বিক্রিও করে দিয়েছেন। কিন্তু এতে আমাদের কী লাভ? শহরে এলেতো লাইসেন্সের জন্য ট্রাফিক পুলিশ আমাদের ধরে রিকশা নিয়ে যায়, জরিমানা করে। সেই জরিমানার টাকাও আমাদের দিতে হয়। তাই মালিকের বদলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাসিন্দা অটোরিকশা চালকদের এসব লাইসেন্স দেওয়া হোক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাহেদ মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পৌরসভা থেকে তিন হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়। তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার শ্রমিকলীগকে নিয়ে ইচ্ছামতো লাইসেন্সগুলো ভাগ করেছে। লাইসেন্সগুলো পেয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা এবং বিত্তবান মালিকরা। এতে আমাদের কোনো উপকারে আসেনি। বরং এসব লাইসেন্স বছরে ৪০-৪৫ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি লাইসেন্সগুলো বাতিল করতে। আমাদের দাবি মালিকদের বদলে রিকশার চালকদের লাইসেন্স প্রদান করা হোক।
পৌরসভার প্রশাসক শংকর কুমার বিশ্বাসও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কিছু পরিবারের মধ্যে এসব লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছিল। আগের লাইসেন্স সবগুলো নবায়ন না করে প্রতিটি পরিবারকে একটি করে লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মীর আনোয়ার হোসেন জানান, অটোরিকশার নকল লাইসেন্স শনাক্ত তারা করতে পারেন না। তবে যানজট নিরসনে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
এফএ/জিকেএস