চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দাদের কেনাকাটার জন্য অন্যতম নির্ভরতার স্থান রিয়াজউদ্দিন বাজার। ঐতিহ্যবাহী এ বাজারটি দেড়শো বছরের পুরোনো। এই বাজারে শাক-সবজি থেকে শুরু করে লাখ টাকা দামের মোবাইল ফোনও মেলে। খুচরার পাশাপাশি চলে পাইকারি বেচাকেনা। বিভিন্ন পণ্যের দামও তুলনামূলক কিছুটা কম। বাজারটির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতার নানান দিক নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে চতুর্থ তথা শেষ পর্ব।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রিয়াজউদ্দিন বাজার অগ্নিঝুঁকির কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অপরিকল্পিত স্থাপনা, গলি ভরাট করে গড়ে ওঠা দোকান ও গুদাম, দাহ্য পণ্য মজুত এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ঘাটতি বাজারটিকে ভয়াবহ ঝুঁকিতে ফেলেছে।
বাজারের ভেতরের সরু গলিগুলোতে যেকোনো সময় আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করাই হবে দুঃসাধ্য। অধিকাংশ ভবন নির্মাণ হয়েছে কোনো নিয়ম না মেনে। নেই পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। দোকান ও গুদামে রাখা কাপড়, প্লাস্টিক, প্রসাধনী ও কাগজসহ দাহ্য পণ্যের কারণে ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ।
তিনশোর বেশি ভবনে ১৮০টি মার্কেট রয়েছে। সেখানে অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার দোকানে প্রতিনিয়ত চলছে বেচাকেনা। অথচ এমন ব্যস্ত একটি মার্কেটে গাড়ি তো দূরের কথা, হেঁটে যাওয়াই দুষ্কর। ফায়ার সার্ভিসের তালিকা বলছে, দুটি মার্কেটই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে
অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রামের ৫৪টি মার্কেট এবং ২৪টি কনটেইনার ডিপো। ফায়ার সার্ভিস একাধিকবার নোটিশ দিলেও সুরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই এসব ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলোর। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঘিঞ্জি মার্কেটে যেকোনো সময় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা ক্রেতা-বিক্রেতাদের। তবে সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে সরু গলিপথ ধরে সারি সারি দোকান বসিয়ে গড়ে উঠেছে এসব মার্কেট। প্রতিদিন হাজারও মানুষের আনাগোনা এখানে। অথচ এসব মার্কেট এতোটাই ঘিঞ্জি যে, সূর্যের আলোও প্রবেশ করে না ঠিকমতো। কেনাকাটার এই জমজমাট বাজার আসলে অগ্নিঝুঁকির এক ভয়াল ফাঁদে রূপ নিয়েছে।
আরও পড়ুন
হাত বাড়ালেই ‘চোরাই ফোন’, দেখেও দেখে না ‘প্রশাসন’মাছ-মাংস থেকে লাখ টাকার ফোন সবই মেলে রিয়াজউদ্দিন বাজারে
দোকান মালিক সমিতির তথ্য বলছে, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও তামাকুমুন্ডি লেইন মিলিয়ে তিনশোর বেশি ভবনে ১৮০টি মার্কেট রয়েছে। সেখানে অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার দোকানে প্রতিনিয়ত চলছে বেচাকেনা। অথচ এমন ব্যস্ত একটি মার্কেটে গাড়ি তো দূরের কথা, হেঁটে যাওয়াই দুষ্কর। ফায়ার সার্ভিসের তালিকা বলছে, দুটি মার্কেটই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।
রিয়াজউদ্দিন বাজারকে অগ্নিঝুঁকি থেকে মুক্ত করতে হলে সরু গলি প্রশস্ত করতে হবে। প্রয়োজনে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে। প্রতিটি দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে। নগর কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যৌথভাবে বাজারের স্থায়ী সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।—বণিক সমিতির সভাপতি সরোয়ার কামাল
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, বাজারের অন্তত ৭০ ভাগ স্থাপনাই অগ্নিঝুঁকিতে। অনেক দোকানে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও সেগুলো অকার্যকর বা অচল। বিদ্যুতের তার জটলা, অতিরিক্ত লোডশেডিং, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের অসচেতনতা, সব মিলিয়ে যে কোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন তারা।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে বাজার সংস্কারের দাবি জানানো হলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির শিকার হওয়ার পর সাময়িক সচেতনতা তৈরি হলেও কিছুদিন পর পরিস্থিতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
নগরবাসী ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দ্রুত বাজারের স্থাপনা পুনর্বিন্যাস, বৈদ্যুতিক তার সংস্কার ও আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করলে অগ্নিদুর্ঘটনায় শুধু কোটি কোটি টাকার ক্ষতিসাধনই নয়, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে।
গত ১০ জুন রিয়াজউদ্দিন বাজারের এম কে সুপার মার্কেটের ছয়তলা ভবনে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল তামাকুমুন্ডি লেইনের রহমান ম্যানশনের তৃতীয় তলায় সন্ধ্যার দিকে একটি জুতার দোকানে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
গত বছরের ১১ নভেম্বর রিয়াজউদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটের ৭ তলা ভবনে জুতার গুদামে আগুন লাগে। ওই বছরের ২৭ জুন রাতে বাজারটির একটি ভবনে আগুন লাগার পর ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তিনজন মারা যায়।
ফায়ার সার্ভিস একাধিকবার নোটিশ দিলেও সুরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই এই ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলোর। এসব বিষয়ে আমরা কঠোর হবো। বিভিন্ন সময় মার্কেট মালিকদের নোটিশ দিচ্ছি।—ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন
মার্কেট মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে বাজারকে পুরোপুরি পরিকল্পিতভাবে সাজানো সম্ভব হয়নি। তবে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপনসহ কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, নগর কর্তৃপক্ষের সহায়তা ছাড়া বড় কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।
তামাকুমুন্ডি লেইন বণিক সমিতির সভাপতি সরোয়ার কামাল জাগো নিউজকে বলেন, রিয়াজউদ্দিন বাজারকে অগ্নিঝুঁকি থেকে মুক্ত করতে হলে সরু গলি প্রশস্ত করতে হবে। প্রয়োজনে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে। প্রতিটি দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বাধ্যতামূলক করতে হবে। নগর কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যৌথভাবে বাজারের স্থায়ী সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরাও তাদের সহযোগিতা করবো।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন (পিএফএম-এস) জাগো নিউজকে বলেন, মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পেছনে যে খরচ এটিকে অনেকে অহেতুক মনে করে। কিন্তু এসব নীতিমালা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং এটি যে একটি বিনিয়োগ তা ব্যবসায়ীরা ভুলে যায়।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস একাধিকবার নোটিশ দিলেও সুরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই এই ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলোর। এসব বিষয়ে আমরা কঠোর হবো। বিভিন্ন সময় মার্কেট মালিকদের নোটিশ দিচ্ছি।
রিয়াজউদ্দিন বাজার শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশের অন্যতম বড় পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। অথচ এ বাজারের প্রতিটি দিন কাটছে অগ্নিঝুঁকিতে। দ্রুত পরিকল্পিত পদক্ষেপ না নিলে যেকোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।
এমআরএএইচ/এমকেআর/জেআইএম