ব্যাংক খাতে অস্থিরতার মধ্যেই গত বছর পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। একে একে ১৪ ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে তারল্য সংকটে পড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে সহায়তা। এরপরও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রায় অর্ধ ডজন ব্যাংক। আমানত টানতে এসব ব্যাংক দিচ্ছে উচ্চ সুদ। এতে ব্যাংক খাতে বাড়ছে ঝুঁকি।
উচ্চ সুদ দিয়ে আমানত টানার প্রতিযোগিতায় ব্যাংক খাতে বাড়ছে অস্থিরতা। আর ‘সুদ ব্যয়ের ফাঁদে’ আটকা পড়ছে দুর্বল ব্যাংক।
ব্যাংক খাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনতে ‘নয়-ছয় নীতি’ গ্রহণ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেওয়ায় দুর্বল ব্যাংকগুলো গ্রাহক টানতে পারছিল না বলে মনে করেন অনেকে। পরবর্তীসময়ে সুদহার সীমা প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের ওপর ১৩ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফার অফার দিচ্ছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক দিচ্ছে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ (আলোচনায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত) এবং পদ্মা ব্যাংক ১৩ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। এছাড়া সিটিজেনস ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক ১১ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত সুদ অফার নিজেদের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বেশি সুদে আমানত টানার মানে হলো ধার করা টাকা থেকে আবার সুদ মেটানো। বিনিয়োগ না থাকলে এটি টেকসই নয়। - অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ জনি
তবে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল ব্যাংকগুলোতে সুদহার তুলনামূলক কম। ব্র্যাক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংকসহ আরও বেশকিছু ব্যাংক আমানতের গড় সুদহার ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার নিচে। ইসলামী ব্যাংকের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই এসব ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানত সন্তোষজনক।
সরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার বর্তমানে সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত। তবে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ১০ শতাংশ সুদ দেওয়ায় সরকারি ব্যাংকের রেটিং কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা। তারপরও তারা মনে করেন, নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংক এখনো একটি ভালো বিকল্প।
বিশ্লেষকদের উদ্বেগবর্তমানে দুর্বল ব্যাংকগুলো বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তবে বিনিয়োগের পথ না খুললে এ কৌশল দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। বরং খেলাপি ঋণ আদায় ও আস্থার সংকট নিরসনই এখন এ খাতের জন্য জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আরও পড়ুনশরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধিতে ধীরগতিগৃহঋণের সীমা বাড়ানোর দাবি এবিবিরপ্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ২৮৭ কোটি তোলার চেষ্টা, আটকালো বিএফআইইউ
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর এই অতিরিক্ত সুদ অফার আসলে নিজেদের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের ভাষায়, বেশি সুদে আমানত টানার মানে হলো ধার করা টাকা থেকে আবার সুদ মেটানো। বিনিয়োগ না থাকলে এটি টেকসই নয়। দুর্বল ব্যাংকগুলোর উচিত খেলাপি ঋণ আদায়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া।
নিরাপদ বিনিয়োগ ছাড়া শুধু আমানত সংগ্রহের চেষ্টা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। সক্ষমতার বাইরে গিয়ে আমানত বাড়ালে তা বাজারকে অস্থিতিশীল করবে। নিরাপদ বিনিয়োগ না বাড়িয়ে কেবল আমানতের পাহাড় গড়ে তোলার কোনো সুফল নেই; বরং অতীত অভিজ্ঞতাই এর ঝুঁকির প্রমাণ। - বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান
ব্যাংকখাত বিশ্লেষক ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকগুলো বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করে নিজেদেরই ক্ষতি করছে। কারণ, বিনিয়োগ না বাড়লে আমানতকারীর সুদ মেটানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে দেখা যাচ্ছে নতুন আমানত এনে সেই আমানত থেকেই অতিরিক্ত সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা টেকসই নয়।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো দুর্বল হওয়ার মূল কারণ খেলাপি ঋণ। তাই আমানত বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় না গিয়ে এসব ব্যাংকের উচিত খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর জোর দেওয়া। অন্যথায় আস্থা হারানো ব্যাংকগুলো শুধু ব্যয় বাড়িয়ে আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘নিরাপদ বিনিয়োগ ছাড়া শুধু আমানত সংগ্রহের চেষ্টা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। সক্ষমতার বাইরে গিয়ে আমানত বাড়ালে তা বাজারকে অস্থিতিশীল করবে। নিরাপদ বিনিয়োগ না বাড়িয়ে কেবল আমানতের পাহাড় গড়ে তোলার কোনো সুফল নেই; বরং অতীত অভিজ্ঞতাই এর ঝুঁকির প্রমাণ।’
দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। একদিকে বিনিয়োগের জন্য অর্থের ঘাটতি, অন্যদিকে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব- এই দুই সমস্যার সমাধান না হলে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। - এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু
বিনিয়োগ খরায় ঝুঁকি বাড়ছেবাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু একই সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ নেমে এসেছে মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আরও পড়ুনধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে জনতা ব্যাংকছয় মাসে ব্যাংক খাতে নারী কর্মী কমেছে দুই হাজারতিন মাসে ব্যাংক আমানত বেড়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা
অর্থাৎ, ব্যাংক খাতে আমানত বাড়লেও একই হারে বাড়েনি বিনিয়োগ। ফলে ব্যাংক খাত ‘সুদ ব্যয়ের ফাঁদে’ আটকা পড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
চলতি বছরের (২০২৫ সালের) জানুয়ারি থেকে মে মাসে সবচেয়ে বেশি আমানত বেড়েছে ব্র্যাক ব্যাংকে। এরপর রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা, ইউসিবি, পূবালী, সিটি ব্যাংক, আইএফআইসি, যমুনা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। এছাড়া এবি ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মিডল্যান্ড, মধুমতি ব্যাংক, এনসিসি, এনআরবি, এনআরবিসি, ওয়ান ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকেও আমানত বেড়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের বড় বাধা।
তিনি বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বজায় থাকলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। একদিকে বিনিয়োগের জন্য অর্থের ঘাটতি, অন্যদিকে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব- এই দুই সমস্যার সমাধান না হলে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’
ইএআর/কেএসআর/এএসএ/জেআইএম