আন্তর্জাতিক

যেভাবে পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগঠনে জড়াচ্ছে বাংলাদেশি তরুণরা

গত ছয় মাসে পাকিস্তানের একটি সশস্ত্র সংগঠনের হয়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে দুজন বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এসেছে। ওই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দুই জনকে গত জুলাই মাসে আটক করে বাংলাদেশের পুলিশ। ফলে কীভাবে বাংলাদেশের তরুণরা পাকিস্তানের এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়াচ্ছে সেই প্রশ্ন সামনে আসছে।

পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর অভিযানে শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সশস্ত্র সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) ১৭ জন সদস্য নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি একজন তরুণকেও শনাক্ত করা হয়েছে। তার নাম ফয়সাল, বাড়ি মাদারীপুরে।

এর আগে গত এপ্রিলে দেশটির উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে আহমেদ জুবায়ের নামে আরেকজন বাংলাদেশির নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টিটিপি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে দুজনকে গত জুলাই মাসে আটক করেছে বাংলাদেশের পুলিশ।

জঙ্গি বিষয়ে কাজ করে ঢাকায় পুলিশের এমন কিছু সূত্র বলছে, টিটিপির জন্য বাংলাদেশ থেকে জনবল সংগ্রহ করার একটি প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই সক্রিয় আছে, যার নেতৃত্বে আছেন ইঞ্জিনিয়ার ইমরান হায়দার নামের এক ব্যক্তি। গত জুলাই মাসে পুলিশেরই দায়ের করা একটি মামলার এজাহার থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা দিকে যারা নজর রাখেন, তারা বলছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে বাংলাদেশি জঙ্গিদের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ‘মুজাহিদ নিয়োগের’ মতো ঘটনাও ঘটেছে।

এছাড়া বাংলাদেশে সক্রিয় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে আল-কায়েদার যোগসূত্র আছে বলেও পুলিশ ও জঙ্গি বিষয়ক গবেষকরা বলে থাকেন। আল-কায়েদার সঙ্গে আবার যোগসূত্র আছে টিটিপির।

পুলিশের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, টিটিপির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন দুজনকে গত জুলাইয়ে আটকের পর বাংলাদেশের ভেতরে এর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। 

যেভাবে টিটিপিতে যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশি তরুণরা

টিটিপি মূলত পাকিস্তানের পাঠান মাদ্রাসা ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠনের একটি জোট। ২০০৭ সালে বাইতুল্লাহ্ মেহ্সুদের নেতৃত্বে ১৩টি সংগঠন মিলে টিটিপি গঠিত হয়।

জোট গঠনের পর থেকেই টিটিপির মধ্যে দলীয় কোন্দল শুরু হয় ও এর জেরে বেশ কয়েকটি উপদল তৈরি হয়। তবে ২০২০ সালে টিটিপি আবার এক হয়। তারা পাকিস্তানে কথিত ‘ইসলামি শাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের হামলার ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে এ সংগঠনটির নাম সামনে এসেছে। সংগঠনটি পাকিস্তানের বাইরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের ‘জিহাদি’ সদস্য রিক্রুট করে থাকে বলে মনে করা হয়।

পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলার জন্য টিটিপিকে দায়ী করা হয়। তাদের হামলার সেনা সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

পাকিস্তান সরকার ২০১৪ সালে টিটিপির সাথে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলো। এরই মধ্যে গত ছয় মাসে পাকিস্তানের মাটিতে দুই জন বাংলাদেশি তরুণ, যারা টিটিপির সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মৃত্যুর খবর সামনে এলো।

এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে জুবায়ের নামে এক বাংলাদেশীর নিহত হওয়ার তথ্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছিলো।

দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআরকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিলো যে, উত্তর ওয়াজিরিস্তানের রাজমাক এলাকায় গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ওই অভিযান চালানো হয়।

বাংলাদেশের জঙ্গি কার্যক্রম বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে নজর রাখছেন মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন। তার মতে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে বাংলাদেশি জঙ্গিদের সম্পৃক্ত হবার বিষয়টি অনেক পুরনো। এমনকি, বায়তুল মোকাররমের কাছে ব্যানার দিয়ে মুজাহিদ সংগ্রহের তৎপরতা দেখেছি আমরা।

নূর খান লিটনের ভাষ্য, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেও এ ধরনের রিক্রুটমেন্টের নজির আছে। তবে এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে তাদের কার্যক্রম। কিন্তু পুরোপুরি যে বন্ধ হয়নি, সেটি পাকিস্তানে দুজনের নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রমাণিত হলো।

বাংলাদেশে টিটিপির কার্যক্রমে জড়িতদের মধ্যে যারা আটক হয়েছেন, তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব কিংবা দুবাই হয়ে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে পৌঁছায় টিটিপি নেটওয়ার্কের সদস্যরা।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে তাদের চ্যানেলে এসব বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে আসছিলো। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গত জুলাই মাসে বাংলাদেশের পুলিশ টিটিপির সাথে সম্পৃক্ত সন্দেহে দুজনকে আটক করতে পেরেছিলো বলে জানিয়েছিলেন পুলিশের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা।

আটককৃতদের মধ্যে একজনকে চলতি বছরের ২ জুলাই রাতে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মোড়ে একটি দোকান থেকে একজনকে ও ১৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জ থেকে আরেকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই টিটিপির সঙ্গে যোগসূত্র থাকার অভিযোগ আনা হয়।

আটক হয়ে কারাগারে যাওয়া ওই দুজনের মধ্যে একজনকে আগেও পুলিশ জঙ্গি কার্যক্রমে সক্রিয় থাকার অভিযোগে আটক করেছিলো। ২০২৩ সালে র‍্যাব জানিয়েছিলো, তিনি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তাদের দুজনকেই এক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

এর বাইরে তখন আরও অন্তত ৩৫ জন বাংলাদেশিকে বালোচিস্তান থেকে আটক করার তথ্য নিরাপত্তা বাহিনীর বরাতে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে এসেছিলো। পরে সেই ব্যক্তিসহ ছয় জন ও তাদের অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিয়মিত মামলা হয়।

মামলায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথমে আটক দুজন ২০২৪ সালের ১৮ই অক্টোবর ঢাকা ছেড়েছিলেন। কিন্তু ওমরাহ না করে তারা পরদিনই সৌদি আরব থেকে পাকিস্তানে যান। সেখান থেকে ৬ই নভেম্বর তুরখান সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানে যান।

একদিন পর ওই একই সীমান্ত দিয়ে তাদের একজন আবার পাকিস্তানে আসেন। এরপর করাচি থেকে দুবাই হয়ে ১৬ই নভেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। কিন্তু তার সহযোগী অপর বাংলাদেশি পরে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন, যার নাম আহমেদ জুবায়ের ওরফে যুবরাজ।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক একজন পুলিশকে এই তথ্য জানিয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার এজাহারে আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে তারাও ‘ধর্মীয় উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়ে’ জিহাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

এই মামলার এজাহারেই বলা হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার ইমরান হায়দার নামে এক বাংলাদেশি টিটিপির হয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মূলত তিনি ওই সংগঠনের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন ও সদস্যদের সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেন।

এজহারে আরও বলা হয়েছে, উক্ত আসামি বাংলাদেশে টিটিপির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির কার্যক্রম, সদস্যদের ইসলামী খিলাফতের দাওয়াত পৌঁছানোর কার্যক্রম পরিচালনা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করছেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ ঘটনার পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য বিনিময় করা হয়েছে। এর ভিত্তিতেই নতুন করে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু হয় বাংলাদেশে।

এর ধারাবাহিকতায় জুলাইতে দুজনকে আটক করা হয়েছে। মামলার এজাহারে আরও যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তাদেরও আটকের চেষ্টা করছে পুলিশ।

ধারণা করা হয়, টিটিপির জন্য জনবল সংগ্রহে কাজ করছিল আটক ব্যক্তিদের একজন ও তার সংগঠন। তারাই লোক বাছাই করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সৌদি আরব বা দুবাই হয়ে পাকিস্তানে টিটিপির নেটওয়ার্কে লোক পাঠায় বলে পুলিশ সূত্রগুলোরও ধারণা।

২০২৩ সালের ২৩শে জুন এই ব্যক্তি ও তার স্ত্রীকে ঢাকার ডেমরা থেকে অস্ত্রসহ আটক করেছিলো তখনকার কাউন্টার টেররিজিম ইউনিট- সিটিটিসি। তখন তাকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করেছিলো পুলিশ।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসএএইচ