জাতীয়

ভুয়া জন্মসনদে ভুগছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৯ হাজার নাগরিক

রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা ইমরান কবির। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের অষ্টম তলায় অঞ্চল-১ এর কার্যালয়ে যান। তাকে কেন ‘ভুয়া জন্মসনদ’ দেওয়া হয়েছে, তার কারণ জানতে চান তিনি। কিন্তু তার কথার সদুত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

আলাপকালে ইমরান কবির বলেন, সনদটি তার বড় ছেলে মাসুদ কবিরের (৪)। সম্প্রতি ওই সনদ নিয়ে পাসপোর্ট করতে গিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন। পাসপোর্ট অফিস থেকে বলা হয়েছে, সনদটি ভুয়া। জাতীয় সার্ভারে তার আন্তঃসংযোগ নেই।

ইমরান কবির বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ হলো নাগরিকদের সেবা দেওয়া। সেখানে তারা নাগরিকদের হয়রানি করছেন। এখন করপোরেশনের লোকজন বলছেন, আবার নতুন করে আবেদন করতে।

আরও পড়ুন:জন্মনিবন্ধন হারিয়ে গেলে কী করবেন?টাকা দিলে আগে মেলে জন্মনিবন্ধন সনদযেভাবে করবেন জন্মনিবন্ধন

সপ্তাহখানেক আগে ডিএসসিসি অঞ্চল-২ এর কার্যালয় (খিলগাঁও) থেকে ছেলে রাসেল রানার জন্য ফের জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছেন নাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে জানতে পারি, সাবেক মেয়র তাপসের আমলে বিতরণ করা জন্মসনদ ভুয়া। তাই নতুন করে আবার আবেদন করেছি। কারণ, কয়েক মাস পর বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। জন্মসনদ ছাড়া বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি নেয় না।’

নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আগে জন্মসনদ নেওয়ার সময় ৫০ টাকা ফি নিয়েছিল সিটি করপোরেশন। এবারও তারা সমপরিমাণ ফি নিয়েছে। তখন তাদের কাছে আগের টাকার কী হয়েছে, জানতে চাইলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। আবার দ্রুত সময়ের মধ্যে সনদ দিতে বললে তারা জানায় জাতীয় সার্ভার ঠিক মতো কাজ করে না।’

ভোগান্তি কমানোর নামে নিজস্ব সার্ভার থেকে প্রায় ৭৯ হাজার জন্মনিবন্ধন সনদ বিতরণ করেছিল ডিএসসিসি। কিন্তু এসব সনদ নিয়ে স্কুল-কলেজে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করতে পারছেন না নাগরিকরা। কারণ, এসব সনদের সঙ্গে জাতীয় সার্ভারের আন্তঃযোগাযোগ নেই। ফলে তথ্য যাচাই করতে না পারায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির মুখে পড়ছেন নাগরিকরা। কোনো উপায় না পেয়ে ফের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন) জাতীয় সার্ভারে আবেদন করছেন ডিএসসিসির বাসিন্দারা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নতুন আবেদনে তাদের কাছ থেকে আবার সরকার নির্ধারিত ফি দিতে হচ্ছে। কিন্তু ডিএসসিসির সার্ভারে আবেদন করার সময় যে ফি জমা দিয়েছেন, সে টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। একইভাবে আগে ডিএসসিসির সার্ভার থেকে যেসব মৃত্যুসনদ বিতরণ করা হয়েছিল, সেগুলোও কোনো কাজে লাগছে না। সবাইকে নতুন করে সনদের জন্য আবেদন করতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন:

জন্মনিবন্ধন করতে খরচ কত?পুরোনো জন্মনিবন্ধন অনলাইন করার নিয়মঘরে বসে অনলাইনে যেভাবে করবেন জন্মনিবন্ধন

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে এমন ভোগান্তির মধ্যে আগামী ৬ অক্টোবর জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস পালন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সঙ্গে রাজস্ব আয়ের ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন সনদ বিতরণের ওই বিতর্কিত উদ্যোগ নিয়েছিলেন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তখন তিনি সরকারের বিভিন্ন সেবা সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের (এমএইউ) চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন-বিধির লঙ্ঘন হওয়ায় কেউ সারা দেয়নি। আবার তাপস তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।

দক্ষিণ সিটির নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন

২০২০ সালে ডিএসসিসির মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। এরপর থেকে করপোরেশনের রাজস্ব আয় বাড়াতে নানান উদ্যোগ নেন তিনি। এর মধ্যে জন্মসনদ বাবদ রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় যে রাজস্ব আয় করে, তার ভাগ চেয়ে বসেন তাপস। এ নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন দ্বন্দ্ব চলছিল। এমন দ্বন্দ্বের কারণে ২০২৩ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল ডিএসএসসি। পরে নাগরিক ভোগান্তি বাড়তে থাকায় ওই বছরের ৪ অক্টোবর থেকে নিজস্ব সার্ভারে সনদ বিতরণ শুরু করে সংস্থাটি। তখন এ সনদের নিবন্ধন ফি’র অর্থ সরাসরি পাচ্ছিল ডিএসসিসি।

তবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের সার্ভারের সঙ্গে তার আন্তঃসংযোগ না থাকায় তখন থেকেই ওই সনদ নিয়ে নাগরিক ভোগান্তি শুরু হয়েছিল। তখন ওই বছরের ১৯ অক্টোবর বিষয়টি অবগত করে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান। পরে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ‘নিজস্ব সার্ভারে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করাকে আইনবহির্ভূত’ উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার সচিবকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছিলেন বর্তমান রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গোপনে দেশ ছাড়েন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এরপর থেকে আবার জাতীয় সার্ভার থেকে জন্মসনদ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়।

আরও পড়ুন:

জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমে জড়িত ‘অসাধু চক্রের’ বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাজন্মসনদ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণে ভোগান্তি, উত্তরে সেবা বন্ধ

ডিএসসিসির আইটি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শেখ তাপসের নির্দেশেই আইনবহির্ভূতভাবে প্রায় সাড়ে ১০ মাসে দক্ষিণ সিটি থেকে ৭৮ হাজার ৯৫৬টি জন্মনিবন্ধন এবং ১ হাজার ৪৭১টি মৃত্যুনিবন্ধন বিতরণ করা হয়েছিল। এসব সনদ বাবদ প্রায় ৪০ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করেছিল ডিএসসিসি। এখন ডিএসসিসিতে ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। এসব ওয়ার্ডের নাগরিকদের ১০টি পৃথক আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে সেবা দেয় করপোরেশন। অর্থাৎ রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে জন্মসনদের আবেদন করে তা করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। ডিএসসিসির অঞ্চল-২ এর রেজিস্ট্রেশন সহকারী (জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন) মো. সাজহার উদ্দিন বলেন, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের জাতীয় সার্ভারে দিনের বেলায় খুবই চাপ থাকে। ইন্টারনেটের উচ্চগতি থাকলেও ঢোকা যায় না। ফলে কারেও তাড়া থাকলেও আগে সনদ বিতরণ করা সম্ভব হয় না। তাই দিনের বেলা যেসব আবেদন জমা পড়ে, সেগুলো রাতে কাজ করতে হয়।

সায়েদাবাদ টার্মিনালের উত্তর পাশে ডিএসসিসির অঞ্চল-৫ এর কার্যালয়। সম্প্রতি এ কার্যালয়ে গিয়েও জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে একই জটিলতার কথা জানা যায়। এই কার্যালয়ের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু আসলাম জাগো নিউজকে বলেন, স্কুলে শিশুদের ভর্তির জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। যেসব অভিভাবক করপোরেশনের নিজস্ব সার্ভার থেকে সনদ নিয়েছে, তারা সবাই ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। প্রতিদিনই এমন লোকজন আঞ্চলিক কার্যালয়ে আসছেন। তখন তাদের কাজটা সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে করা হয়। তবে এ জটিলতার কথা অনেক অভিভাবক অবগত হয়েছেন। তারা নতুন করে আবেদন করে সনদ নিচ্ছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’ দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্র জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে জন্মনিবন্ধন সনদের প্রয়োজন হয়। এমন ২২টি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের এমওইউ আছে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪-এর ৭ (ক) (২) এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারায় এসব এমওইউ করা হয়েছে।

এ আইনের ৭ (ক) (২) ধারায় বলা আছে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের দায়িত্ব ও কার্যাবলি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। আর বিধিমালার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারায় উল্লেখ আছে, সফটওয়্যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের। তাই ডিএসসিসি যেটি করছিল তার আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না।

ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে সনদ বিতরণ কার্যক্রম ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, যেখানে জন্ম ও মৃত্যুসনদ বিতরণে জাতীয় সার্ভার রয়েছে, সেখানে করপোরেশনের সনদ বিতরণ করা ঠিক হয়নি।

তিনি বলেন, ‘করপোরেশনে যোগ দেওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে বেশ অভিযোগ পেয়েছি। তাই করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি, আগে যারা জন্মসনদ নিয়েছেন, তারা যদি ফের আবেদন করেন তা হলে তাদের সেবা যাতে আন্তরিকতার সঙ্গে দেওয়া হয়।’

আগে জন্ম ও মৃত্যুসনদ বাবদ যে ফি নেওয়া হয়েছে, তা কেন সমন্বয় করা হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে যে ফি নেওয়া হয়েছে, তা নাগরিকদের ফেরত বা নতুন আবেদনে যুক্ত করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ওই টাকা কীভাবে নেওয়া হয়েছে, কোন খাতে আছে তা জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো।’

এমএমএ/এসএনআর/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম