প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই ৮ হাজার শিখর আরোহণ করে ইতিহাস গড়েছেন দেশের স্বনামধন্য পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী। গত ২৬ অক্টোবর ভোরে তিনি স্পর্শ করেছেন পৃথিবীর অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট মানাসলু (২৬,৭৮১ ফুট) চূড়া। এটি তার চতুর্থ আটহাজারি শৃঙ্গে সফলতা। তিনি ছাড়াও একই দিনে মানাসলু পর্বতের শিখরে আরোহণ করেছেন দেশের আরেক পর্বতারোহী তানভীর আহমেদ। এটি তানভীরের প্রথম আটহাজারি শিখর অভিযান ও প্রথম অভিযানেই আসে এই সাফল্য।
শনিবার (৪ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে অভিযান পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন ও পতাকা প্রত্যর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘মানাসলু অ্যাসেন্ট: ভার্টিক্যাল ডুয়ো’ শীর্ষক এই অভিযানের আয়োজক পর্বতারোহণ ক্লাব ভাটিক্যাল ড্রিমার্স।
এতে দুই পর্বতারোহী ছাড়াও পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ‘সামুদা’ এর চিফ বিজনেস অফিসার বিকাশ কান্তি দাস এবং ভিজুয়াল নিটওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ নুর ফয়সাল উপস্থিত ছিলেন।
বিকাশ কান্তি দাস বলেন, সামনের দিনগুলোতেও দেশের তরুণ অ্যাথলেটদের পাশে দাঁড়ানো হবে। স্যাম-বন্ড সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এই অভিযানে সম্পৃক্ত হয়েছে।
ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ক্লাবের পাবলিক রিলেশন্স সেক্রেটারি আশরাফুল আরেফীন আসিফ। আর পুরো অভিযানের ব্যবস্থাপক হিসেবে ছিলেন ফরহান জামান।
অনুষ্ঠানের পরিচালক আশরাফুল আরেফীন আসিফ বলেন, নেপালের মানসিরি হিমাল রেঞ্জে অবস্থিত বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ পর্বত মানাসলুতে আমাদের দুই পর্বতারোহী বাবর ও তানভীরের সৌজন্যে একই দিনে দুইবার উড়ল লাল-সবুজের পতাকা। ব্যাপারটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য বিশাল গর্বের। আমাদের ছেলেরাও যে পর্বতারোহণ নামক স্পোর্টসে দারুণ কিছু করে দেখাতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাবর-তানভীর জুটি। সামনের দিনগুলোতেও আমরা তাদের দুজনের কাছ থেকে দারুণ সব আরোহণের দেখা পেতে উন্মুখ হয়ে আছি। দেশের পর্বতারোহণ জগৎকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতেও এই দুজনকে সমূহ ভূমিকা রাখতে দেখতে চাই সামনের দিনগুলোতে।
নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত বাবরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া আটহাজারি শিখর আরোহণের। তিনি ইতঃপূর্বে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত এভারেস্ট, চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসে এবং দশম সর্বোচ্চ পর্বত অন্নপূর্ণা-১ নামে তিনটি আট হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার পর্বত আরোহণ করেন। তবে অক্সিজেনবিহীন এবারের আরোহণ দেশের পর্বতারোহণকে দিয়েছে অনন্য মাত্রা।
আরও পড়ুনমাউন্ট মানাসলু অভিযানে যাচ্ছেন বাবর আলী ও তানভীরমানাসলু পর্বতে কৃত্রিম অক্সিজেনহীন প্রথম বাংলাদেশি বাবর
সংবাদ সম্মেলনে বাবর বলেন, পশ্চিমারা কত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে হিমালয় থেকে দারুণ সব আরোহণের কৃতিত্ব ঝুলিতে নিয়ে বাড়ি ফেরে। অথচ আমাদের বাড়ির পাশের হিমালয় হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আমাদের কৃতিত্বের ছাপ খুব একটা বেশি নয়। নানা দেশের পর্বতারোহীদের দেখে আগে ভাবতাম, আমি বা আমরাও যদি আট হাজার মিটার বা তার অধিক উচ্চতার শিখরে কৃত্রিম অক্সিজেনবিহীন আরোহণ করতে পারতাম। অবশেষে সেই স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দিলো। এই অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়।
তিনি বলেন, আশা করি, পরের পর্বতারোহীরাও সেই ধারা অব্যাহত রাখবে। তবে পর্বতে যাওয়াটা কোনো খেয়ালি ব্যাপার কিংবা দিবাস্বপ্ন নয়। এর পেছনে দীর্ঘ সাধনা আর প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। প্রস্তুতির ব্যাপারটাতে সবাই যাতে আরও বেশি মনোযোগ দেয়, সেই প্রত্যাশা থাকবে আমার।
অনুষ্ঠানে তানভীর বলেন, যেহেতু আমাদের দেশে ওই অর্থে পর্বত কিংবা হিমবাহ নেই, সেহেতু দেশের বাইরে গিয়ে পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাতে আমার ঘাটতি ছিল। তবে দেশে ক্লাবের সদস্যদের সাহায্যে প্রশিক্ষণ, নিয়মিত অন্যান্য অনুশীলন আর একাগ্রতার মাধ্যমে আমি সেই ঘাটতি কাটিয়ে উঠেছি। এই ব্যাপারে অনুশীলনের প্রতি আমার একাগ্রতা আমাকে প্রভূত সাহায্য করেছে।
তিনি বলেন, ৮ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত সব সময়ই কঠিন। তার ওপর এটি ছিল আমার প্রথম আট হাজার মিটার পর্বত। নানান শঙ্কা নিয়ে আমি পর্বতের পাদদেশে পৌঁছেছি। তবে একবার পাতলা বাতাসের রাজ্যে হাজির হতেই আমার সব শঙ্কা কেটে গেছে। আমার এত দিনের প্রস্তুতি এ ক্ষেত্রে আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে সহ-অভিযাত্রী হিসেবে বাবরের মতো অভিজ্ঞ কাউকে পাওয়াটাও ছিল দারুণ ব্যাপার।
তানভীর ও বাবর বাংলাদেশ থেকে নেপালে যান ৫ সেপ্টেম্বর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৭ সেপ্টেম্বর তারা কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে যান তিলচে গ্রামে। এরপর পাঁচ দিন হেঁটে তারা পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। সেখানে দুইদিন বিশ্রাম তারা শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া।
প্রথম দফা ক্যাম্প-১ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে তারা নেমে আসেন। একদিন বিশ্রামের পর দ্বিতীয় দফা আরোহণে তানভীর ক্যাম্প-২ (৬৩০০ মিটার) এবং বাবর ক্যাম্প-৩ (৬৭০০ মিটার) এ রাত কাটিয়ে শেষ করেন অতি উচ্চতা ও নিম্ন তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব।
একদিন বেসক্যাম্পে বিশ্রামের পর আসে চূড়ান্ত চেষ্টার ক্ষণ। তানভীর ২২ সেপ্টেম্বর বেসক্যাম্প থেকে যাত্রারম্ভ করে উঠে আসেন ক্যাম্প-১ এবং পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২। এদিকে বাবর একদিন পর রওনা দিয়ে সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ।
২৪ সেপ্টেম্বর দুইজনেই ক্যাম্প ৩ তে রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ পৌঁছে যান ক্যাম্প-৪ এ (৭৪০০ মিটার)। বাকিবেলা বিশ্রাম করে রাত নামতেই শুরু হয় তাদের পরম আরাধ্য চূড়ার দিকে যাত্রা। আর ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরেই তারা পৌঁছে যান পর্বত শীর্ষে।
বাবর আলী দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভাটিক্যাল ড্রিমার্সের সাধারণ সম্পাদক এবং তানভীর আহমেদ এই ক্লাবের মাউন্টেনিয়ারিং বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত। তানভীর গত বছর অন্যতম টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম সামিট করেন, প্রথম বাঙালি হিসেবে যেই পর্বত ২০২২ সালে সামিট করেছিলেন বাবর।
‘ভিএফ এশিয়া বাংলাদেশ’ এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত তানভীর কিশোরগঞ্জ সদরের খরমপট্টি নিবাসী এড. তারেক উদ্দিন আহমদ এবং শিরীন আহমেদ এর প্রথম সন্তান এবং নিজেই এক কন্যা সন্তানের পিতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি এর ২০০৬ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।
আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচে এমবিবিএস পাস করা ডা. বাবর আলী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগম এর দ্বিতীয় সন্তান।
এমআরএএইচ/এমআইএইচএস/জেআইএম