কৃষি ও প্রকৃতি

মৃতপ্রায় খালে বিপন্ন জনপদ, বোরো ধান চাষে অনিশ্চয়তা

সৈয়দ মাজারুল ইসলাম রুবেল

বরিশাল জেলার গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রবাহমান ঐতিহ্যবাহী একসময়ের খরস্রোতা টরকী-বাসাইল খালটি নাব্য সংকট, দখল ও দূষণে আজ মৃতপ্রায়। বিপন্ন হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষি, জীবন ও প্রকৃতি। দীর্ঘদিন খাল খনন না করায় খাল ও নদীর নাব্য সংকটে নদী থেকে খালে পানি প্রবেশ করছে না। এ ছাড়া কোনো কোনো জায়গায় বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণ, খালের জায়গা দখল করে কাঁচা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ, নির্বিচারে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় খালটির আজ বেহাল দশা।

টরকী-বাসাইল খালটি একসময় এ অঞ্চলের প্রধান চলাচলের নৌপথ ছিল। রাস্তা পাকা হওয়ায় সড়কপথে যোগাযোগের জনপ্রিয়তা বাড়ে। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে খালটি ধীরে ধীরে নাব্য হারিয়ে ফেলে। যার প্রভাব পড়ে বোরো ধান আবাদের মৌসুমে। বিশেষ করে শীত মৌসুমে খালে মোটেও পানি থাকে না। খালটির পানি সেচের ওপর নির্ভর করে এ অঞ্চলের প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান আবাদ।

টরকী-বাসাইল খালে মূলত আড়িয়াল খাঁ নদের শাখা পলরদী নদী থেকে পানি প্রবেশ করে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির স্তর নিচে নেমে গেলে খালে পানি প্রবেশ করে না। যার স্থায়ী সমাধান খাল খননের মাধ্যমে নদী ও খালের নাব্য সমন্বয় করা। কিন্তু সেটি না করে নদী ও খালের পানি প্রবেশমুখে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে নদী থেকে খালে পানি ওঠানো হয়। ইজারার মাধ্যমে স্থানীয় ঠিকাদার সেচ প্রকল্প পরিচালনা করেন।

সেচ প্রকল্পের এই পানি কয়েক হাত বদল হয়ে কৃষকদের কিনতে হয় উচ্চমূল্যে। যার ফলস্বরূপ কৃষকেরা ধান চাষে বিকল্প হিসেবে পান চাষ করছেন এবং মাছের ঘের করছেন। যে কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে ধান চাষের জমির পরিমাণ। অন্যদিকে খালের নাব্য সংকটের কারণে বর্ষা মৌসুমে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে খালগুলো পানিতে টইটুম্বুর হয়ে পানিতে তলিয়ে যায় পানের বরজ এবং মাছের ঘের।

আরও পড়ুনহুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ও সুনীল অর্থনীতিবাংলাদেশের মাটিতে ল্যাভেন্ডার চাষ করা সম্ভব

একদিকে পানির অভাবেও চাষিরা জমি চাষ করতে পারছেন না। অপরদিকে প্রতি ২০ শতাংশ জমি চাষ করতে পানি-সেচ বাবদ ৩ শতাংশের ধান দিতে হয়। ধানের দাম কম, সে তুলনায় খরচ বেশি হওয়ায় বর্গাচাষিদের জমি আবাদে অনীহা দেখা যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জমির মালিকসহ সাধারণ বর্গাচাষিরা। স্থানীয় জমির মালিক, কৃষক, বর্গাচাষি সবাই ভুক্তভোগী।

এ খালের ওপর নির্ভর করে একসময় বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। পাওয়া যেত শতেক প্রজাতির দেশীয় মাছ। খালটি মরে যাওয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয়রা। খালটি স্রোতহীন হয়ে পড়ায় বদ্ধ পানিতে জন্ম নিচ্ছে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ-জীবাণু। যা এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

খালটি নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি। গণমাধ্যমে এ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে হাজারও সংবাদ প্রকাশিত হলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। গত বোরো আবাদের মৌসুমে ভুক্তভোগী কৃষকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বরাবর খালটি খননের উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের দাবি, খালটিকে দখল ও দূষণমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নাব্য সংকট দূর করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা।

লেখক: পরিবেশকর্মী, ক্লাইমেট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ।

এসইউ/এএসএম