ভারত যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়েছে। এটা পরিষ্কার। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের রোষানলে। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সম্পর্ক এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যা কোল্ড ওয়ারের ৭০ বছরে দেখা যায়নি। নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সবাইকেই যুক্তরাষ্ট্র উষ্ণতা দেখিয়েছেন, সম্পর্ক নার্সিং করতে চেষ্টা করেছে। হ্যারি ট্রুম্যান, ডোয়াইট ডি আইসেন আওয়ার, জন এফ কেনেডি সবাই ভারতীয় নেতাদের প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জওয়াহারলাল নেহেরুকে যুক্তরাষ্ট্রে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে কেনেডি বলেছিলেন, ‘তিনি একজন বিশ^নেতা, তার চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একমত।’
১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিনডন বি. জনসন তার বিবৃতিতে বলেছিলেন,‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুতে গোটা আমেরিকা শোকাহত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের নেতা হিসাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন। তার মৃত্যু মানবতা, শান্তি ও অগ্রগতির পথে একটি বড় ধাক্কা।’
চিরশত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা ভারতকে ‘দি লারজেস্ট ডেমোক্রেসি’ বলতেই অভ্যস্ত ছিলেন। কথা সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কখনো কখনো তিক্ততাও তৈরি হয়েছে ভারতের, কিন্তু তারও একটি মাধুর্য ছিল। যেমন ১৯৭১ সালের কথা। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুই বিপরীত মেরুতে। যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে মতানৈক্যের কারণে সরাসরি বলেছিলেন, “ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু মনে করে, বস নয়। ভারত তার নিজের পথ বেছে নিতে জানে। আমরা জানি এবং বুঝি যে কখন কী করতে হবে।” তখন হেনরি কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধীকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এসে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার, আপনি কী প্রেসিডেন্টের প্রতি আরেকটু সহনশীল হতে পারতেন না?”
সোজা কথায়, ভারত চিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্র দাঁত বসাতে পারবে না, এটা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু ঘরের কোণে চিনের মত দৈত্যকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অধিক মাখামাখি করলে বারবার ভারতকে নানা ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এমনকি চিনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়েও আসবে না, এগিয়ে আসলেও তা খুব কার্যকর হবে না। সুতরাং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ভারতের এখন চিনকেই প্রাধান্য দেওয়া শ্রেয় বলে মনে করি।
জবাবে ইন্দিরা বলেছিলেন, “আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ মি. সেক্রেটারি। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আমাদের সোজা একটি মেরুদণ্ড আছে...সব ধরনের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস ও শক্তি আমাদের আছে। আমরা প্রমাণ করবো যে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শাসন করার কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার দিন চলে গেছে।” এতবড় তিক্ততাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুছে গিয়েছিল। ভারতকে দরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের। কিন্তু কী এমন ঘটল যে ট্রাম্প-মোদি সম্পর্ক একেবারে মধু থেকে অম্লতে পরিণত হল? বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে চিন, যাকে মোকাবেলার জন্য ভারতকে প্রয়োজন সর্বাধিক? তখনকার ভারতের যে দৃঢ় শিড়দাঁড়া ছিল তা এখন দেখা যাচ্ছে না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২৪ সালে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলে অনেক ভারতীয় আনন্দে উল্লসিত হয়েছিল। এই আনন্দের পেছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা। যেহেতু ট্রাম্প ব্যক্তিগত সম্পর্ককে খুবই প্রাধান্য দেন। আর দ্বিতীয় কারণটি হল, ট্রাম্পের প্রশাসনে একদল ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান। হোয়াইট হাউসের সিনিয়র পলিসি উপদেষ্টা নিয়োজিত হন শ্রীরাম কৃষ্ণন, বিবেক রামাস্বামীকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সদ্যগঠিত ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির দায়িত্ব দিয়েছেন এলন মাস্কের সঙ্গে। রামাস্বামী নিজেও রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু পরে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়ান।
এছাড়াও এফবিআই’র পরিচালক ক্যাশ প্যাটেল, ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস-এ হারমিত ধীলন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর প্রধান জয় ভট্টাচার্য্যসহ আরো কিছু গুরুদায়িত্ব পেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুতরা। খোদ ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের স্ত্রী উষা ভ্যান্স একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড ভারতীয় না হলেও একজন সনাতন ধর্মানুসারি। খুশি তো ভারতীয়দের হওয়ারই কথা। কিন্তু সে আনন্দ ম্লান হতে সময় লাগেনি।
আমরা আমাদের সামাজিক জীবনে দেখি, একজন মানুষ অন্য ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে যখন প্রবেশ করে তখন অধিক ধার্মিক হয়ে ওঠে। তার আনুগত্য প্রকাশের জন্য সে অধিক সচেষ্ট থাকে। ঠিক তেমনি ট্রাম্প প্রশাসনে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কারো মধ্যে এখন পর্যন্ত ভারতের প্রতি আচরণে সহানুভূতিশীল দেখা যায়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষ উল্টোটা ঘটে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট একা কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। তার আশেপাশের ক্যাবিনেট সদস্য ও উপদেষ্টারা তাকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং তার প্রতিফলন ঘটে প্রেসিডেন্টের কার্যক্রমে।
খুবই স্পষ্ট দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুখে ‘মোদি আমার বন্ধু, ভারত একটি মহান দেশ’ বলে বলে যে কয়টা বাঁশ তার হাতে ছিল, সব কয়টি ধরিয়ে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। ট্রাম্প আদ্যোপান্ত একজন ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি বিশ্ব রাজনীতিকেও তার ব্যবসায়ী দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেন। বিশ্বব্যাপী শুল্ককে তিনি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক আদর্শ বলতে তিনি বোঝেন, যে দেশের সঙ্গে লাভ সেই দেশ হলো সবচেয়ে বড় বন্ধু। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে তিনি যে-সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা রাজনীতি এবং ব্যবসাকে ছাড়িয়ে রীতিমতো আক্রোশের পর্যায়ে উঠেছে। কেন, এবং কী সেই আক্রোশ?
প্রথম আক্রোশটি একান্ত ব্যক্তিগত এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অন্যত্র এ ঘটনা উল্লেখ করেছি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, নির্বাচনের এক বছর পূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে মোদির এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। মোদিও তাকে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিলেন।
তিনি ধারণা করলেন ট্রাম্প এবারো প্রেসিডেন্ট হবেন। ততদিনে অবশ্য দু’জনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ওই সফরের সময় ‘দি টেক্সাস ইন্ডিয়া ফোরাম’ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হাউসটনে বিশাল এক বর্ণাঢ্য আয়োজন করে, যার নাম দেওয়া হয় হাউদি মোদি। প্রকৃত পক্ষে এই আয়োজন ছিল ট্রাম্প ও মোদির যৌথ উদ্যোগে। ট্রাম্প তখন ভাষণ দিতে উঠে বলেছিলেন, মোদি তাকে ওই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছেন। মোদি স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষের সামনে বলে আসেন ‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার’। অর্থাৎ’ তিনি ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে পুনরায় নির্বাচিত করতে ভারতীয়দের সমর্থন চান। এতে দু’জনের মধ্যে আরো ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। ট্রাম্পও ‘আমি ভারতকে ভালোবাসি’ বলে মোদিকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেন।
ট্রাম্প ভারতীয়-আমেরিকানদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের পেয়ে আমরা গর্বিত। তখন থেকেই ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদিকে ‘মাই ফ্রেন্ড’ বলে সম্বোধন করতেন। এর পাঁচ মাস পর ২০২০ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প ভারত সফর করেন এবং তাকে গুজরাতের নরেন্দ্র মোদি (বর্তমান নাম) স্টেডিয়ামে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামের ওই অনুষ্ঠানে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ওই বছর নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ট্রাম্প। বাইডেন সব অবলোকন করলেও নানা বিবেচনায় ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর সিদ্ধান্তের কথা হয়তো ভাবেননি। সম্পর্ক স্বাভাবিক ও অব্যাহত রেখেছেন।
এই সকল হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায় ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনের পূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোয়াড এর সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার সফরের পূর্বেই রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প মিশিগানে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে আমার বন্ধু মোদি আসছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। সে ফ্যান্টাস্টিক।’ কিন্তু হায়! মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে দেখাই করলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ট্র্যাডিশনে নির্বাচনের পূর্বে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সফরে গেলে তিনি সিটিং প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
মোদি সেটা করলেন না, উল্টো বাইডেনের স্ত্রীকে ২০ হাজার ডলার দিয়ে ল্যাবে তৈরি হীরার আংটি উপহার দিলেন। ধারণা আছে, মোদিকে ভারতীয় দূতাবাস থেকে তথ্য দেওয়া হয়েছিল যে এবার ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হবেন এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হবেন। সেই অনুসারে মোদি আর ঝুঁকি নিতে চাননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় এবং ট্রাম্প ফের আরেক দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
এবার তার প্রতিশোধের মুখোশ খুলে গেল! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রথম লক্ষণটিই দিল্লির জন্য সুখকর ছিল না। ২০ জানুয়ারি সেই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত ছিলেন যুক্তিরাষ্ট্রে অবস্থানরত খালিস্তান আন্দোলনের শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপাতওয়ান্ত পান্নুন। অনুষ্ঠানে সবাই যখন ‘ইউএসএ’ ‘ইউএসএ’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল, তখন পান্নুনের কণ্ঠে শোনা যায় ‘খালিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান।
এটি নিঃসন্দেহে দিল্লির কাছে আপত্তিকর। এরপর একে একে আঘাত আসতে থাকে। ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের অভিবাসীকে গ্রেফতার করে যার যার দেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভারতীয়দের যেভাবে পিঠ মোড়া করে বেঁধে, অপমানিত করে সামরিক বিমানে করে ভারতে পাঠিয়েছেন তা বিরল। বন্ধু মোদির দেশে এভাবে অভিবাসন প্রত্যাশীদের ফেরত পাঠানো সারা বিশ্বের চোখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একটি অভিবাসীদের দেশ এবং ট্রাম্পের পরিবারও সেখানে অভিবাসিত। সেটা অন্য আলোচনা।
তারপর বড় ধাক্কা দিলেন ট্যারিফ বা শুল্কে। ট্যারিফ প্রশ্নে ভারতকে অন্যতম টার্গেট করে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। ২৫ শতাংশ সাধারণভাবে এবং আরো ২৫ শতাংশ পেনাল্টি হিসাবে। পেনাল্টি কীসে? অভিযোগ, ভারত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়া থেকে জ্বালানি কিনছে এবং অন্যত্র তা বিক্রি করছে।
জ্বালানি কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো এখনো রাশিয়া থেকে কিনছে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে অযুহাত হল, কিনে আবার তার কিছু অন্যত্র বিক্রি করছে। সত্যিই বন্ধু ভাবলে এ বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারতেন ট্রাম্প। কারণ এ বিষয় নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কিংবা ইউরোপের পক্ষ থেকে কোনো চাপ ছিল না প্রেসিডেন্টের প্রতি। যদিও ইউরোপ পরে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
এ ছাড়াও গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান চারদিনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, যুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬ বিমানের জন্য ও আইএমএফ-এর পাকিস্তানের অনুকূলে অর্থ ছাড়, যুদ্ধ পরবর্তীতে পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল হওয়া জেনারেল অসিম মুনিরকে ডিনারে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক- এসব কিছু ভারতকে শুধুই হতাশ করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৩০ বারের অধিক দাবি করেছেন তিনি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ থামিয়েছেন, যা দিল্লীকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
আরো একটা আঘাত দিয়েছেন ভারতকে। পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১বি ভিসার জন্য একজন আবেদনকারীকে খরচ করতে হতো ২ থেকে ৫ হাজার ডলার। গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই আবেদনের জন্য ১ লক্ষ ডলার ধার্য করেছেন। অস্বাভাকিই বটে। এই ভিসা সাধারণত মেডিক্যাল চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের দেওয়া হয়। প্রতি বছর ৬৫ হাজার ভিসা প্রদান করা হয় এবং আরো ২০ হাজার দেওয়া হয় যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ডক্টরেট করেছেন তাদের জন্য। এই ভিসায় দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করার এবং ভালো আয়ের ব্যবস্থা থাকে। এতকাল এই ভিসার ৭০ শতাংশ ভারতীয়রা পেয়েছে। এখন স্থানীয় মুদ্রা প্রায় ৯০ লক্ষ রুপি দিয়ে ভিসা আবেদন বহু ভারতীয়র পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। ট্রাম্প যে ভারতীয়দের টার্গেট করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশে^র অন্যতম কোম্পানি অ্যাপল ৯০ শতাংশ প্রোডাক্ট অ্যাসম্বল করে থাকে চিনে। অ্যাপল সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিন থেকে সরিয়ে ২৫ শতাংশ ভারতে অ্যাসম্বল করবে। ট্রাম্প সম্প্রতি অ্যাপলের সিইও টিম কুককে বলেছেন, ‘আমার প্রিয় বন্ধু, আমি তোমাকে খুবই ভালো জানি। তুমি ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা এনেছ। এখন শুনতে পাচ্ছি তুমি ভারতে বিভিন্ন জায়গায় কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করছ। আমি চাই না যে তোমরা ভারতে এই ব্যবসা কর।’ ট্রাম্পের এই রকম একটি পরিস্থিতিতে ভারতকে নড়েচড়ে বসতে হচ্ছে। বহু ভারতীয় মনে করেন, অথবা তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে যে ভারত একটি উদীয়মান অর্থনীতি, তাই যুক্তরাষ্ট্র আগে ভাগে ভারতীয় অর্থনৈতিক উত্থানকে ঠেকাতে চাইছে।
এটি সম্পূর্ণরূপে একটি ভাঁওতা কথা। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বীর আসরে চিন। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ভারতের জিডিপি চিনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। আগামী ৫০ বছরেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ভারতের জন্য অসম্ভব। বরং ২০৩০ সালের মধ্যে চিন সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে এটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বারবার উল্লেখ করছেন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল, ট্রাম্প চিন সম্পর্কে একটিও বাজে মন্তব্য করেননি এবং চিনের সঙ্গে দফায় দফায় বাণিজ্যিক আলোচনা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াশিংটনে গভীর সমালোচনা রয়েছে। খোদ ভারত থেকেই অভিযোগ উঠেছে, দেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। এছাড়াও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে ভারতের আশেপাশে ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে উত্থানে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করছে।
এমন ভয়ানক পরিস্থিতি যে ভারত সরকার বুঝতে পাছে না তা নয়। তবে কঠিন এক দোটানায় পড়েছে যা থেকে একটি নিরাপদ প্লাটফর্মে অবস্থান নেওয়া কঠিনতর হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি অনুধাবন করে ভারত চিনের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। বলা যায় একটি ভারসাম্য আনতে চেষ্টা করেছে।
আরো একটি দূরত্ব ভারতের সঙ্গে তৈরি হয়েছে ব্রিকস প্রশ্নে। ব্রিকসে রয়েছে চিন, রাশিয়া, ব্রাজিল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্রিকস মূলত অর্থনৈতিক সহযোগিতার সংগঠন হলেও যুক্তরাষ্ট্র এই সংগঠনকে জি-৭ এর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সংগঠন বলে মনে করছে।
একটা বিষয় এখন মাথায় রাখা দরকার। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন সম্পর্ক হয় ইস্যুভিত্তিক। যেমন, তাইওয়ান প্রশ্নে ভয়ানক বৈরিতা যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের। আবার মে মাসে ভারত পাকিস্তান চারদিনের যুদ্ধে দেখা গেছে চিন ও যুক্তরাষ্ট্র একই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। চিন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের ভলিউম বিশে^র সবচেয়ে বড়। আবার মিয়ানমার প্রশ্নে এই মুহূর্তে ভারত ও চিন প্রায় একই লাইনে দাঁড়িয়ে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিপক্ষ। এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়।
এই জটিল সমীকরণ নিয়ে আরো অনেক কথা বলার আছে যা স্বল্প পরিসরে সম্ভব না। তবে ভারত যদি মনে করে কোল্ড ওয়ারের সময়ের মত দুইদিক সামলাবে তা এখন আর কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। ভারতকে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক বেছে নিতে হবে চিন ও যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যে। একই সঙ্গে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়াডে থাকবে তা হবে না। সেক্ষেত্রে চিন ভারতকে বিশ্বাস করবে না।
সোজা কথায়, ভারত চিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্র দাঁত বসাতে পারবে না, এটা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু ঘরের কোণে চিনের মত দৈত্যকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অধিক মাখামাখি করলে বারবার ভারতকে নানা ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এমনকি চিনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়েও আসবে না, এগিয়ে আসলেও তা খুব কার্যকর হবে না। সুতরাং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ভারতের এখন চিনকেই প্রাধান্য দেওয়া শ্রেয় বলে মনে করি।
লেখক: সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।
এইচআর/জিকেএস