বন্দর নগরী চট্টগ্রামের একটি অতি ব্যস্ত সড়ক মাঝিরঘাট। পাশেই কর্ণফুলী নৌ-জেটি। খালাস হওয়া পণ্য বড় ভারী ট্রাকে পরিবহন করা হয় এ সড়ক দিয়ে। সড়কের পাশে শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সড়কটিতে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। বর্ষায় পানি জমে। শুকনোর সময় ধুলায় ঢাকে পুরো এলাকা। এতে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীসহ স্থানীয়রা।
সড়কের গর্তে পড়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, যানবাহন বিকল হয়ে তৈরি হয় যানজটও। সম্প্রতি সড়কটিতে নামকাওয়াস্তে মেরামতে নেমেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বিগত পাঁচ বছরে বেশ কয়েকবার মেরামত হয়েছে সড়কটি। তবে টেকে না। বর্তমানে আট কোটি টাকার মেরামত কাজটিও চলছে ঢিমেতালে।
নগরীর সদরঘাট থানা পেরিয়ে মাঝিরঘাটের দিকে যেতেই বন্দরের লাইটারেজ জেটি, পদ্মা অয়েল কোম্পানির প্রধান কার্যালয়, বিআইডব্লিউটিসির সদরঘাট টার্মিনাল, সদরঘাট নৌ-থানা, পুরোনো কাস্টমস-ভ্যাট-এক্সাইজ অফিস রয়েছে। সদরঘাট মোড় থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত নৌযান থেকে পণ্য খালাসের অসংখ্য জেটি বাদেও বেশ কয়েকটি লবণ মিল, কয়েকশ গোডাউন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় থাকায় সদরঘাট থেকে রশিদ বিল্ডিং পর্যন্ত সড়কটি অত্যন্ত ব্যস্ত। রাত-দিন শত শত ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি আসা যাওয়া করে সড়কটি দিয়ে। বিশেষ করে মাঝিরঘাট এলাকায় বেশ কয়েকটি ওজন স্কেলে গাড়ির ওজন নিতে গিয়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর মাদারবাড়ি রশিদ বিল্ডিং মোড় থেকে শুরু করে বাংলাবাজার, স্ট্যান্ড রোড, মাঝিরঘাট হয়ে সদরঘাট মোড় পর্যন্ত পুরো সড়কটিতে গর্ত আর ধুলার রাজত্ব। আবার বৃষ্টির পর দেখা যায় অন্য রূপ। পুরো সড়কটি কর্দমাক্ত হয়ে সাধারণের চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
স্ট্যান্ড রোড দিয়ে চলা খুবই কষ্টকর। হাঁটলেও শরীরের জামাকাপড় ধুলায় নষ্ট হয়ে যায়। আশপাশের বিল্ডিংসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধুলার আস্তর জমেছে। মাঝে-মধ্যে সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটানো হলেও তা খুবই নগণ্য।-স্থানীয় ব্যবসায়ী নুরুল আলম মুন্সী
পুরো সড়কটির আশপাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট মালিকরা বেকায়দায় দিনাতিপাত করছেন। ধুলায় বিবর্ণ হয়ে গেছে আশপাশের সবুজ গাছপালাও। প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কটি রশিদ বিল্ডিং মোড় থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত অসংখ্য গর্ত একেকটি ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে স্ট্যান্ডরোডের অবস্থা একেবারে নাজুক। তবে বাংলাবাজার এভারগ্রিন ঘাট থেকে সদরঘাট মোড় পর্যন্ত কয়েকটি অংশে আরসিসি সড়ক নির্মাণের কাজ করছে সিটি করপোরেশন।
আরও পড়ুনএক সড়কেই দিন পার, ক্ষতির মুখে ব্যবসা-বাণিজ্যখাস কালেকশনের নামে রাজস্বের টাকা ভাগাভাগিচট্টগ্রাম ওয়াসায় বিল বকেয়া ১৬০ কোটি টাকা, সিংহভাগই সরকারি
স্ট্যান্ড রোড এলাকায় যানজটে আটকা পড়া একটি ট্রাকের চালক মো. সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ১৪ বছর ধরে মাঝিরঘাট এলাকায় নিয়মিত গাড়ি চালাই। বারিকবিল্ডিং থেকে সদরঘাটের মাথা পর্যন্ত পুরো সড়কটিতে গর্তের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। সড়কটি সঠিকভাবে মেরামতে কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় লোড (বোঝাই) গাড়ি গর্তে পড়ে বিকল হয়ে যায়। অনেক গাড়ি কাত হয়ে রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়ছে। গাড়ির চাকাসহ নিচের অংশের পার্টস ভেঙে যাচ্ছে। গাড়ি বিকল হয়ে পুরো সড়কে যানজট লেগে যায়। কোনো গাড়ি কাত হয়ে গেলে সেটি সরাতে পুরো দিনও লেগে যায়। এসময় রাস্তাটি দিয়ে যারা চলাচল করেন, তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।’
মাঝিরঘাট এলাকার একটি চটের দোকানের কর্মচারী রুহুল আমিন। মুখে মাস্ক পরা ২৪ বছরের রুহুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছর ধরে এ দোকানে চাকরি করছি। দুই বছর আগে পুরোপুরি কার্পেটিংয়ের নতুন সড়ক বানানো হয়েছিল। কিন্তু টেকসই হয়নি। এখানে ট্রাক ও লরিগুলো ভারী পণ্যবাহী। শুষ্ক মৌসুমে কিছুটা ভালো থাকলেও বর্ষায় সড়কটি কর্দমাক্ত হয়ে যায়। এখন পুরো সড়কটিই নষ্ট হয়ে গেছে। বড় বড় গর্তে বৃষ্টির পানি জমলে পুকুরের মতো দেখায়।’
পরিবার নিয়ে স্ট্যান্ড রোড এলাকায় বসবাস করেন মাঝিরঘাট এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘এটি ব্যস্ত সড়ক। মাঝিরঘাটে অসংখ্য গুদাম রয়েছে। একদিকে গুদামে পণ্য আনা-নেওয়া হয়, অন্যদিকে বন্দরের কয়েকটি জেটি রয়েছে। জেটিগুলো দিয়ে স্ক্র্যাপ, সার, সিমেন্ট ক্লিংকার আনলোড হয়। এসব পণ্যের মধ্যে বিশেষ করে স্ক্র্যাপ ও ক্লিংকার পরিবহন করতে ভারী লরি ও ট্রাক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব গাড়ির ভার বহন করার মতো করে সড়ক নির্মাণ কিংবা মেরামত করা হয় না। যে কারণে নতুন করে মেরামত করার পরপরই সড়ক ভেঙে শত শত গর্ত তৈরি হয়।’
দিনে গাড়ির প্রচণ্ড চাপ থাকে। যে কারণে সড়কটি মেরামতের ম্যাটেরিয়ালস আনা-নেওয়া করতে বেগ পেতে হচ্ছে, সময় বেশি লাগছে। আশা করছি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মেরামত কাজ শেষ হবে।-চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান
তিনি বলেন, ‘প্রথমে ছোট গর্ত হয়। শুরুতেই এসব গর্ত মেরামত হলে গর্ত বড় হওয়া থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেগুলো নিয়মিত তদারকি করে না। ফলে এসব গর্ত বড় হয়ে পুরো সড়কই চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এখন সড়কটি দিয়ে আশপাশে বসবাসরতদের সন্তানের স্কুল-কলেজে যেতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে সামান্য বৃষ্টি হলে পুরো সড়ক কাদায় ভরে যায়।’
মাঝিরঘাট এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী নুরুল আলম মুন্সী বলেন, ‘সড়কটি নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে নানান কাজ চলছে। দেড় বছর গেছে তিনটি কালভার্ট নির্মাণে। কয়েকমাস আগে কালভার্ট নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে ড্রেনের কাজ। তবে ড্রেনের কাজ চলছে বাংলাবাজার এলাকায়। মাঝিরঘাটের দিকে কিছু রাস্তা কার্পেটিং করলেও তাও নষ্ট হওয়ার পথে। আবার মাঝিরঘাট স্কেলের সামনে নতুন করে বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা ভেদ করে ওয়াসার লাইনের ছিদ্র দিয়ে ওঠা পানি পুরো রাস্তা সয়লাব হয়ে গেলেও এসব সমস্যা সমাধানে কারও কোনো দায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘স্ট্যান্ড রোড দিয়ে চলা খুবই কষ্টকর। হাঁটলেও শরীরের জামাকাপড় ধুলায় নষ্ট হয়ে যায়। আশপাশের বিল্ডিংসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধুলার আস্তর জমেছে। মাঝে-মধ্যে সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটানো হলেও তা খুবই নগণ্য।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সদরঘাট থেকে রশিদ বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত সড়কটিতে বেশ কয়েকটি অংশে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সড়কটিতে গাড়ির চাপ বেশি। চলাচলকারী গাড়িগুলোর মধ্যে ভারী গাড়ি বেশি। ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর জরুরিভিত্তিতে মাঝিঘাটর এলাকায় বেশ কয়েকটি অংশে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কয়েকটি প্যাকেজে কাজগুলো চলছে। বর্তমানে প্রায় আট কোটি টাকার মেরামত কাজ চলছে। এসব কাজ মানসম্মতভাবে ভারী গাড়ির ব্যবহার উপযোগী করে করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দিনে গাড়ির প্রচণ্ড চাপ থাকে। যে কারণে সড়কটি মেরামতের ম্যাটেরিয়ালস আনা-নেওয়া করতে বেগ পেতে হচ্ছে, সময় বেশি লাগছে। আশা করছি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মেরামত কাজ শেষ হবে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম