খেলাধুলা

এই প্রথম বিসিবিতে নেই মোহামেডান-আবাহনীর প্রতিনিধি

এটা সত্য যে, ঢাকাই ক্রীড়াঙ্গনে মোহামেডান আর আবাহনীর সেই দৌরাত্ম্য ও প্রতাপ এখন আর নেই। তারপরও, রাজধানী ঢাকা তথা দেশের খেলাধুলায় মোহামেডান আর আবাহনী অনেক বড় নাম। অনেক জনপ্রিয়। স্বাধীনতার পর থেকে সাদা-কালোর মোহামেডান আর আকাশি-হলুদ আবাহনী সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেই হয়েছে দর্শকনন্দিত, পেয়েছে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাঠের সাফল্যের মূল রূপকার খেলোয়াড়রা। প্রশিক্ষকদের ভূমিকাও আছে প্রচুর। কিন্তু সংগঠকদের ভূমিকাও কম নয়। তারাই দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মোহামেডান আর আবাহনীকে দল হিসেবে বাকিদের চেয়ে ভালো, শ্রেয়তর করে সাজিয়েছেন।

মাঠে খেলোয়াড়রা ভালো খেলে বাকি দলগুলোকে পিছনে ফেলে সাফল্যের মালা গলায় পরালেও, ইতিহাস জানাচ্ছে আসলে সংগঠকদের হাত ধরেই ঢাকাই ক্লাব ক্রীড়াঙ্গন তথা ফুটবল, ক্রিকেট ও হকিতে সবার ওপরে উঠে গেছে মোহামেডান আর আবাহনী। কারণ, স্বাধীনতার পর ৭০ দশকের প্রায় শুরু থেকেই সাদা-কালো আর আকাশি-হলুদ শিবিরের ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি সংগঠকরা দেশের বেশিরভাগ মেধাবী, প্রতিভাবান, দক্ষ খেলোয়াড়দের আবাহনী ও মোহামেডানে এনে দল গড়েছেন। আর সেই একঝাঁক সেরা খেলোয়াড়রা মাঠে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে একের পর এক সাফল্য উপহার দিয়েছেন নিজ নিজ ক্লাবকে। নিজ ক্লাবের সাফল্যের মঞ্চ সাজানোর এই মোহামেডান ও আবাহনীর নিবেদিতপ্রাণ, দক্ষ সংগঠকরা বিভিন্ন সময় জাতীয় পর্যায়েও রেখেছেন বড় অবদান।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির সফল সংগঠকদের তালিকা করতে গেলে মোহামেডান আর আবাহনীর সংগঠকদেরই এগিয়ে রাখতে হবে। এদেশে ফুটবলে যারা প্রবাদপ্রতিম সংগঠক বলে পরিচিত, তাদের বড় অংশই মোহামেডান আর আবাহনীর।

একসময় যেমন মোহামেডান আর আবাহনী ছাড়া জাতীয় দল হতো না। ফুটবলে ২২ জনের মধ্যে ১৫-১৬ জনই থাকতেন এই দুই জনপ্রিয় দল থেকে। ক্রিকেটের ১৫-১৬ সদস্যের স্কোয়াডেও মোহামেডান আর আবাহনীর থাকতেন প্রায় ৮ থেকে ১০ জন। একই অবস্থা ছিল হকিতেও। স্কোয়াডের মূল অংশই থাকতো মোহামেডান আর আবাহনীর।

একইভাবে, ৭০ দশকের শেষভাগ থেকে ৮০, ৯০ দশক এবং বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকে এই সেদিন পর্যন্ত তিন প্রধান খেলার ফেডারেশনের শীর্ষ পদে আবাহনী আর মোহামেডানের সংগঠকদেরই ছিল প্রাধান্য।

ফুটবলে মেজর হাফিজউদ্দীন, শেখ আকমল হোসেন, আনোয়ারুল হক হেলাল, বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, ক্রিকেটে আমিনুল হক মনি, প্রয়াত তানভির হায়দার আর মাহবুব আনামরা মোহামেডানের হয়ে ৮০’র দশক থেকে ক্লাবের গণ্ডি পেরিয়ে ফুটবল ফেডারেশন আর ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

মোহামেডানের তুখোড় ফুটবলার মেজর হাফিজ বাফুফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুটি শীর্ষ পদেই ছিলেন। সাদা-কালোদের অপর দুই সাধারণ সম্পাদক শেখ আকমল আর আনোয়ারুল হক হেলালও বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের বড় পদে ছিলেন।

ক্লাবে কখনো সাধারণ সম্পাদক হতে না পারলেও, নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠক আমিনুল হক মনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় বিসিবির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

তানভির হায়দার আর মাহবুব আনামও কখনো সাদা-কালো শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হতে পারেননি, কিন্তু বিভিন্ন সময় বিসিবিতে সহ-সভাপতি সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।

একইভাবে, হারুনুর রশিদ, তানভির মাজহার তান্না (যদিও তিনি ক্রিকেটে ছিলেন আজাদ বয়েজের ক্রিকেটার ও সংগঠক এবং ৮০ দশকের মাঝামাঝি বিসিবির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন), কর্নেল কাজী শাহেদ, অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু, মঞ্জুর কাদের আর সাবের হোসেন চৌধুরীরা ফুটবলে ৭০, ৮০ ও ৯০ দশকে ছিলেন আবাহনী ফুটবলের শীর্ষ সংগঠক।

আর আ হ ম মোস্তফা কামাল, আফজালুর রহমান সিনহা, সাবের হোসেন চৌধুরী, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি ও জালাল ইউনুস, জি এস হাসান তামিম, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, আকরাম খান ও নাইমুর রহমান দুর্জয়রা বিভিন্ন সময় ক্রিকেট বোর্ডে আবাহনীর প্রতিনিধিত্ব করে বড় বড় পদে ছিলেন।

হারুনুর রশিদ দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাফুফের ৫ বারের সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবের হোসেন চৌধুরীও বিসিবির দুইবারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

একটা মজার তথ্য জেনে নিন। সাবের হোসেন চৌধুরী ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি মনোনীত হন। যেদিন তিনি বিসিবি প্রধান হন, তখনও তিনি আবাহনী ফুটবল কমিটির অন্যতম শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

দীর্ঘ সময় আবাহনীর সহ-সভাপতি আর ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান থাকা আ হ ম মোস্তফা কামালও বিসিবির একবারের সফল সভাপতি ছিলেন।এছাড়া আবাহনীর দীর্ঘদিনের সঙ্গী আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি বিসিবির কার্যনির্বাহী সদস্য, যুগ্ম সম্পাদক ও সহ-সভাপতি পদেও ছিলেন বিভিন্ন সময়। জালাল ইউনুসও দীর্ঘদিন বিসিবির গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। লিপু, আকরাম ও দুর্জয়রা বিসিবি পরিচালক ছিলেন।

হকিতে খন্দকার জামিল উদ্দীন, দেলোয়ার হোসেন দিলু আর সাজেদ আদিল মোহামেডানের পাশাপাশি হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। সাজেদ আদিল আর খন্দকার জামিল মোহামেডানের ব্যানারেই হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন।

আবাহনীর ফুটবল ও হকি ক্যাপ্টেন আব্দুস সাদেক (বর্তমান বিসিবি পরিচালক ইশতিয়াক সাদেকের পিতা) হকি ফেডারেশনের ২ বারের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রয়াত জাহিদুর রহমান পুশকিন, মামুন (হারুনুর রশিদের ছোট ভাই) আবাহনীর হয়ে হকিতে একসময় যুগ্ম সম্পাদক ফেডারেশনের বড় কর্তার পরিচয়েই ছিলেন।

বর্তমান শতাব্দীতেও ক্রিকেট, ফুটবল আর হকি ফেডারেশনে আবাহনী ও মোহামেডানের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সালাউদ্দিন, বাদল রায়, সালাম, আসলামরা বাফুফের উচ্চ পদে আসীন ছিলেন। এরপর আবাহনীর এহসান রানা আর মোহামেডানের আরিফুল হক প্রিন্স এই সেদিনও হকি ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

মোদ্দা কথা, ৭০, ৮০, ৯০ দশকের পুরো সময়, এমনকি এবার বিসিবির কমিটি হওয়ার আগ পর্যন্তও ফুটবল ফেডারেশন ও ক্রিকেট বোর্ডে মোহামেডান আর আবাহনীর প্রতিনিধিত্ব ছিল। বিসিবির সর্বশেষ সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এর আগের নির্বাচনে ছিলেন আবাহনীর কাউন্সিলর। একইভাবে, বিসিবির অন্যতম পরিচালক মাহবুব আনাম ছিলেন মোহামেডানের প্রতিনিধি।

কিন্তু এবার আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে যে ২৫ জনের পরিচালক পর্ষদ গঠিত হলো, তাতে দেশের দুই জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের একজন প্রতিনিধিও নেই।

শুরুর দিকে মোহামেডানের মাহবুব আনামের কথা শোনা গেলেও তিনি স্বেচ্ছায় কাউন্সিলরশিপ না নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলে গেছেন। একইভাবে মোহামেডানের কাউন্সিলরশীপ পেয়ে বিসিবিতে নির্বাচন করার লক্ষ্যে মনোনয়নপত্র তুলে জমা দিয়েও তা তুলে নিয়েছেন মাসুদুজ্জামান।

আগেরবার মাহবুব আনামের সাথে মোহামেডানের কাউন্সিলর হওয়া মঞ্জুরুল আলম এবার মোহামেডানের কাউন্সিলর হতে পারেননি। তবে প্লাটফর্ম পাল্টে তিনি বোর্ড পরিচালক হয়েছেন। আবাহনীর কাউন্সিলর হিসেবে দলটির অনেক দিনের সঙ্গী বশির আল মামুনের নাম থাকলেও তিনি নির্বাচন করার ইচ্ছে প্রকাশ করেননি। তাই বিসিবি নির্বাচনে আবাহনীর এবার কোন অস্তিত্বই ছিল না।

ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে আর একবার বিসিবির কমিটিতে মোহামেডানের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। সেটা ওয়ান ইলেভেনের সময়, মানে ২০০৭ সালে। তখন লে. জেনারেল সিনা ইবনে জামালির নেতৃত্বে যে অ্যাডহক কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার প্রাথমিক কমিটিতে আবাহনীর প্রতিনিধি হিসেবে আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি আর গাজী আশরাফ হোসেন লিপু থাকলেও প্রাথমিকভাবে মোহামেডানের কেউ ছিলেন না। পরে সেলিম ভূঁইয়ার জায়গায় তখনকার মোহামেডানের ক্রিকেট কমিটি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর বোর্ড কর্তা হিসেবে জায়গা পান।

কাজেই সে অর্থে আবাহনী আর মোহামেডান দুই দলের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া ক্রিকেট বোর্ড এবারই প্রথম।

এআরবি/এমএমআর/জেআইএম