মতামত

যে কোনো বিপর্যয়ে মনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি

আগামীকাল ১০ অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫। মানুষের জীবনে যে কোনো সময় আচমকা যে কোনো বিপদ-আপদ ঘটতে পারে, বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হতে পারে, জরুরি সংকটে ডুবে যেতে পারে বিশ্বের যে কোনো দেশের যেকোনো ব্যক্তি, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ নেই। নানা ঘটনা-অনুঘটনা আচমকা চারপাশ লন্ডভন্ড করতে পারে, নিজের শরীর-মনও আক্রান্ত করতে পারে।

বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও যে ভীষণভাবে জরুরি এবার তারই গুরুত্ব তুলে ধরেছে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ (WFMH) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে Access to Service: Mental Health in Catastrophes and Emergencies.

Catastrophes বা বিপর্যয় বলতে আমরা কী বুঝব?

বিপর্যয় শব্দের অর্থ হলো আকস্মিক বড় ক্ষতি বা ধ্বংসাত্মক ঘটনা, বিশৃঙ্খল অবস্থা, ওলটপালট অবস্থা বা স্বাভাবিক জীবনধারার কোনো কিছুর সম্পূর্ণ উল্টে যাওয়া। একে ‘দুর্যোগ’ও বলা হয়। উদাহরণ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্প। তবে ছোটোখাটো ঘটনাও জীবনকে হঠাৎ করে ওলটপালট করে দিতে পারে।

বিপর্যয়ের অন্য অর্থ ও সমার্থক শব্দও রয়েছে আর তা হলো: বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস-- বিশৃঙ্খল বা ছত্রভঙ্গ অবস্থা, যা কোনো জিনিস বা পরিস্থিতির ধ্বংস ডেকে আনে।

ওলটপালট বা উল্টে যাওয়া: কোনো সাধারণ বা স্থিতিশীল অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত বা উল্টো অবস্থায় চলে যাওয়া।

ব্যতিক্রম: স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে কোনো ঘটনা বা অবস্থা।

সর্বনাশ বা কোনো কিছুর সম্পূর্ণ বিনাশ বোঝাতেও এই শব্দ ব্যবহার করা যায়। এ ধরনের 'বিপর্যয় কিংবা জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন পাওয়া যায়'- এ উদ্দেশ্যটাই প্রতিপাদ্যের প্রধান বিষয়।

কেন?

জরুরি পরিস্থিতিতে আক্রান্ত প্রায় সকলেই মানসিক চাপে ভোগেন। সমস্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকেও মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে, মানসম্মত সেবার প্রাপ্যতা থেকে ভুক্তভোগীকে বঞ্চিত করে। আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, পূর্ব থেকে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা জরুরি অবস্থায় বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি।

কেন এ ধরনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হলো?

প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ যুদ্ধ, সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো জরুরি পরিস্থিতির শিকার হন। এসব সংকট পরিবার, জীবিকা ও জরুরি সেবা ব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। আগেই বলেছি, আক্রান্ত প্রায় সবাই মানসিক চাপে পড়েন, কেউ কেউই পরবর্তীকালে বিষণ্নতা বা PTSD-এর মতো রোগে আক্রান্ত হন। জরুরি পরিস্থিতি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও সামাজিক সংকট যেমন দারিদ্র্য ও বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। নতুন সমস্যাও সৃষ্টি হয়—পরিবারে বিচ্ছেদ, ক্ষতিকর নেশা গ্রহণ ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা অনুযায়ী, জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহায়তার (MHPSS) জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

['MHPSS stands for Mental Health and Psychosocial Support. It refers to any local or external support aimed at promoting psychological well-being and preventing or treating mental health conditions, often in the context of humanitarian emergencies or adversity.']

সহায়তার জন্য কী কী পদক্ষেপকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়েছে?

সম্প্রদায়ভিত্তিক সহায়তা, সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি গ্রহণ, প্রাথমিক মানসিক সেবা ও ক্লিনিকাল স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নিশ্চিত করা। যেকোনো সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি এবং দুর্যোগ-ঝুঁকি কমানোর কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় অপরিহার্য। জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের সুযোগ মূলত সার্বিক উন্নয়নের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ আর তাই মানসিক সেবার নানা ধরনের পদক্ষেপকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে আর্থিক বিনিয়োগের মাধ্যমেও। সমন্বিত সহায়তা বাড়িয়ে আক্রান্তদের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে পাশে দাঁড়ালে দীর্ঘমেয়াদি সেবার মানউন্নয়ন সম্ভব।

বিপর্যয় কিংবা জরুরি অবস্থায় সমস্যা ব্যাপক।

ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। পূর্ব থেকে চলমান দারিদ্র্যতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য আরও ব্যাপক ও বিধ্বংসী রূপে আবির্ভূত হতে পারে সংকটে। পরিবারের বিচ্ছেদ, নিরাপত্তাহীনতা, জীবিকা হারানো, সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়া, অবিশ্বাস, সম্পদ হ্রাস; মানবিক সহায়তা-সৃষ্ট অতিরিক্ত ভিড়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অভাব, সম্প্রদায়ের সহায়তা কাঠামো দুর্বল হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তোলে । খাদ্য বা জরুরি সেবা কোথায় পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে তথ্যের অভাব থেকে সৃষ্ট উদ্বেগ সংকট ঘনীভূত করে। মানসম্মত ও সাশ্রয়ী মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পাওয়ার অনিশ্চয়তা,স্বাস্থ্যকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, জনবল সংকট, ওষুধ সরবরাহ ব্যাহত হওয়া, চাহিদা বেড়ে যাওয়া, সমন্বয়ের অভাব, জরুরি সেবাদানকারীদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি-সবকিছুই ভিকটিমের মধ্যে চরম হতাশা জাগিয়ে তোলে-- অধিকাংশ মানুষই উদ্বেগ, দুঃখ, হতাশা, ঘুমের সমস্যা, অবসাদ, বিরক্তি, রাগ বা শারীরিক ব্যথায় ভোগেন। সাধারণত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যাগুলো কমে আসে, তবে কেউ কেউ দীর্ঘস্থায়ী মানসিক রোগে আক্রান্ত হন--প্রায় ২২% মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, PTSD, বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়া দেখা দেয়। প্রায় ১৩% মানুষ হালকা মাত্রার বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও PTSD-তে ভোগেন, আর ৯% মাঝারি থেকে গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হন( Lancet 2019 WHO review)। এটি একদম সঠিক।

সংঘাতপ্রবণ এলাকায় বিষণ্নতার হার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায়, এবং মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। গুরুতর মানসিক রোগীরা জরুরি অবস্থা ও তার পরবর্তী সময়ে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং মৌলিক চাহিদা ও ক্লিনিকাল সেবার প্রয়োজন হয়।

দিবসটি উপলক্ষে প্রস্তাবিত পদক্ষেপ কী?

আন্তর্জাতিক MHPSS নির্দেশিকা জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়েকটি পদক্ষেপ সুপারিশ করে: সকল সেক্টরের জরুরি প্রস্তুতি পরিকল্পনায় MHPSS অন্তর্ভুক্ত করা; একটি আন্তঃসেক্টরাল MHPSS টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা; সম্প্রদায়ভিত্তিক সহায়তা শক্তিশালী করা, বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; সামনের সারির কর্মীদের Psychological First Aid-এ((PFA) প্রশিক্ষণ দেওয়া; ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা; সাধারণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা, mhGAP Humanitarian Intervention Guide (mhGAP-HIG) ব্যবহার করে; দীর্ঘস্থায়ী মানসিক কষ্টে ভোগা ব্যক্তিদের জন্য প্রমাণভিত্তিক(Evidenced based) মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা নিশ্চিত করা; গুরুতর মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা ও সুরক্ষা প্রদান করা; মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সাধারণ চিকিৎসক, সম্প্রদায়ভিত্তিক সহায়তা ও অন্যান্য জরুরি সেবার মধ্যে রেফারেল নেটওয়ার্ক তৈরি করা।

পুনর্গঠন: দেশে দেশে

জরুরি পরিস্থিতির পর ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা অপরিহার্য। তবে এসব সংকট মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করার সুযোগও সৃষ্টি করে। সহায়তা বৃদ্ধি ও এ খাতের প্রতি মনোযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশই দীর্ঘমেয়াদি সেবা উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে।

আসুন আমরা মনের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হই এবং জরুরি অবস্থায় আরো বেশি মনোসংকটকে গুরুত্ব দেই। স্মরণে রাখতে হবে “মনের সুস্থতাই মানবতার শক্তি। বিপর্যয়ের সময় মানবিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিক যত্নই পারে ভবিষ্যতে জাতি পুনর্গঠনের ভিত্তি গড়ে তুলতে।”

সিরিয়ার আরব প্রজাতন্ত্র: চলমান সংঘাত সত্ত্বেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতালভিত্তিক চিকিৎসার বাইরে গিয়ে এখন বহু শহরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছেছে।

শ্রীলঙ্কা: ২০০৪ সালের সুনামি মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং WHO-র সহায়তায় জাতীয় পর্যায়ে সংস্কার আনে। আজ দেশের প্রতিটি জেলায় মানসিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো আছে, যেখানে সুনামির আগে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জেলায় ছিল।

ফিলিপাইন: ২০১৩ সালের টাইফুন হাইয়ানের পর WHO ও অংশীদাররা মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বড় ধরনের সম্প্রসারণ ঘটায়। ১৩০০-র বেশি কমিউনিটি কর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীকে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

WHO-এর অংশীদারিত্ব

WHO বিশ্বব্যাপী কাজ করছে যেন জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ সমন্বিত ও কার্যকর হয়। সংস্থাটি জরুরি অবস্থার পর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আফগানিস্তান, চাদ, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনসহ বহু দেশে WHO কাজের ধারা বিস্তৃত হয়েছে।

২০২৪ সালে WHO ও অংশীদাররা ইউক্রেনের জন্য MHPSS রোডম্যাপ প্রণয়নে সহায়তা করে, যেখানে ২৫০-রও বেশি সংস্থা ও জাতীয় কর্তৃপক্ষ যুক্ত হয়। এছাড়া, ২০২৪ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে জরুরি পরিস্থিতির সব ধাপে MHPSS জোরদারের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং WHO Comprehensive Mental Health Action Plan 2013–2030 বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।

WHO বর্তমানে IASC MHPSS Reference Group-এর সহ-সভাপতি, যা ৫৫টিরও বেশি দেশে কার্যক্রম সমর্থন করছে। এছাড়া, WHO Standby Partners Network-এর মাধ্যমে বড় ও জটিল জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছে।

WHO বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে কাজ করছে টুলস ও রিসোর্স উন্নয়নে, যেমন MHPSS Minimum Services Package। এটি জরুরি মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়ার মান ও পরিধি বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে । এছাড়া, WHO বৈশ্বিক কর্মশালা ও বাস্তবমুখী multisectoral simulation exercise আয়োজনের মাধ্যমে প্রস্তুতি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

আসুন আমরা মনের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হই এবং জরুরি অবস্থায় আরো বেশি মনোসংকটকে গুরুত্ব দেই। স্মরণে রাখতে হবে “মনের সুস্থতাই মানবতার শক্তি। বিপর্যয়ের সময় মানবিক সহায়তার পাশাপাশি মানসিক যত্নই পারে ভবিষ্যতে জাতি পুনর্গঠনের ভিত্তি গড়ে তুলতে।”

Source: WFMH

References

1. Charlson F, van Ommeren M, Flaxman A, Cornett J, Whiteford H, Saxena S. New WHO prevalence estimates of mentaldisorders in conflict settings: a systematic review and meta-analysis. Lancet. 2019;394(10194):240–48.(https://doi.org/10.1016/S0140-6736(19)30934-1)2. Mental Health and Psychosocial Support Minimum Services Package (MHPSS MSP). (https://www.mhpssmsp.org/en

লেখক: মনোশিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক, শব্দঘর।

এইচআর/এমএস