মতামত

বন্ধন সুদৃঢ় করে সমঝোতা

মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে সমঝোতা। ইসলাম এমন একটি শান্তিপ্রিয় ধর্ম যেখানে বিশৃঙ্খলার কোনো স্থান নেই। অথচ সমাজের একটি বৃহৎ শ্রেণি এমন রয়েছে যারা ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত ঝগড়াবিবাদে জড়িয়ে যায়। কখনো কখনো এই ঝগড়াবিবাদ আবার হত্যা পর্যন্ত গড়ায়।

বর্তমান প্রায় দেখা যায় অতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে দুই গ্রামের লোকজনের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে তা রক্তপাত এবং পরস্পরের বাড়িঘর পর্যন্ত জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়ার সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। অনেকে হয়তো জানেও না যে কি কারণে তারা এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।

ইসলামের শিক্ষা হলো : কারো সাথে কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য দেখা দিলে তাদের মাঝে যেন সমঝোতা করিয়ে দেয়া হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন : ‘সন্ধি সর্বাবস্থায়ই উত্তম।’ (সুরা আন নিসা, আয়াত : ১২৮) কিন্তু বর্তমান দেখা যায় কোথাও কারো সাথে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা উভয়ের মাঝে সমঝোতা না করিয়ে বরং বিষয়টিকে আরো কঠিন করা হয়।

পারস্পরিক ঐক্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতি যে প্রশংসনীয় এবং মানবজাতির একান্ত কাম্য, তাতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও দেশ-কাল-নির্বিশেষে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করে। জগতের কোথাও এমন কোনো লোক নেই যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝগড়া-বিবাদকে উত্তম মনে করে। এ কারণে বিশ্বের সব দল ও গোত্রই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানায়। তাই আসুন, সামান্য বিষয়ে একে অপরে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়ে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ হই।

হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুই ব্যক্তির মাঝখানে ইনসাফ সহকারে সমঝোতা স্থাপন করে দেওয়া সদকা হিসেবে গণ্য। ’ (বুখারি)

সকল সমস্যার সমাধান পবিত্র কুরআনে রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন : ‘আর মুমিনদের দু’দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদের মাঝে তোমরা মীমাংসা করে দিও। এরপর তাদের মাঝে একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করলে যে দল সীমালঙ্ঘন করে তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। এরপর তারা (আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে) ফিরে এলে তোমরা উভয়ের মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সাথে মীমাংসা করে দিও এবং সুবিচার কর। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।” (সুরা আল হুজরাত, আয়াত : ৯)

আল্লাহতায়ালা আরো ইরশাদ করেন : ‘লোকদের গোপন সলাপরামর্শে প্রায়ই কোনো কল্যাণ নিহিত থাকে না। অবশ্য কেউ যদি গোপনে কাউকে দান করার জন্য উপদেশ দেয় অথবা কোনো ভালো কাজের জন্য অথবা লোকদের পরস্পরের কাজকর্মের সংশোধন করার জন্য কাউকে কিছু বলে তবে তা নিশ্চয়ই ভালো।’ (সুরা আন নিসা, আয়াত : ১১৪)

হাদিসে উল্লেখ হয়েছে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘প্রতিদিন, যেদিন সূর্য উদিত হয়, মানবদেহের প্রতিটি গ্রন্থির (জোড়া) সদকা আদায় করা প্রয়োজন। দুই ব্যক্তির মাঝখানে সুবিচার সহকারে সমঝোতা স্থাপন করে দেয়া সদকা হিসেবে গণ্য। কোন ব্যক্তিকে সওয়ারিতে আরোহণ করতে সহায়তা করা অথবা তার মাল-সামান তার সওয়ারির পিঠে তুলে দেয়া সদকারূপে গণ্য। পবিত্র ও উত্তম কথাবার্তা সদকা হিসেবে পরিগণিত। নামাজে যাওয়ার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ সদকা হিসেবে গণ্য, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করাও সদকারূপে গণ্য।’ (বুখারি ও মুসলিম)

মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদিস থেকে আমরা কি শিক্ষা লাভ করলাম?

এই হাদিস থেকে যে বিষয়টি আমাদের মাঝে স্পষ্ট হলো, আমরা যদি কারো বিরোধ দূর করে দিতে সাহায্য করি তাহলে আল্লাহপাকের দরবারে তা সদকা হিসেবে গণ্য হবে। কত সুন্দর একটি আমল হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা কিন্তু খুব সহজেই এই নেক আমলটি করতে পারি। আসলে আমরা যখন একে অপরের জন্য শান্তি কামনা করবো তখন দেখবেন পুরো সমাজ কতটা সুন্দর হয়।

হাদিসে আরো এসেছে হজরত সাহল ইবনে সাদ সায়েদী বর্ণনা করেছেন, ইমানদারদের সাথে একজন ইমানদারের সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমন দেহের সাথে মাথার সম্পর্ক। সে ইমানদারদের প্রতিটি দুঃখকষ্ট ঠিক অনুভব করে যেমন মাথা দেহের প্রতিটি অংশের ব্যথা অনুভব করে। (মুসনাদে আহমাদ)

আমি যে সমাজে বসবাস করি সেখানে যদি কোন ঝগড়াবিবাদ দেখা দেয় তাহলে একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের কর্তব্য তা মেটানোর চেষ্টা করা। একই সাথে এই চেষ্টাও করতে হবে কোনোভাবেই যেন দু’জনের ঝগড়ায় পুরো গ্রাম শামিল না হয়ে যায়।

হাদিসে এসেছে হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) ও হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে সহযোগিতা করা পরিত্যাগ করে না এবং তাকে লাঞ্ছিত ও হেয় করে না। কোনো ব্যক্তির জন্য তার কোনো মুসলমান ভাইকে হেয় ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করার মতো অপকর্ম আর নেই। (মুসনাদে আহমাদ)

পারস্পরিক ঐক্য, মৈত্রী ও সম্প্রীতি যে প্রশংসনীয় এবং মানবজাতির একান্ত কাম্য, তাতে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও দেশ-কাল-নির্বিশেষে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করে। জগতের কোথাও এমন কোনো লোক নেই যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝগড়া-বিবাদকে উত্তম মনে করে। এ কারণে বিশ্বের সব দল ও গোত্রই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানায়। তাই আসুন, সামান্য বিষয়ে একে অপরে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়ে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ হই।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।masumon83@yahoo.com

এইচআর/এএসএম