ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একসময় বর্ণবাদী, বিশৃঙ্খলার নকশাকার এবং গাজার জন্য অযৌক্তিক স্বপ্নদ্রষ্টা বলেছিল হামাস। অথচ এখন সেই ট্রাম্পের ওপর ভরসা করেই গাজার জিম্মিদের মুক্তি দিয়ে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জুয়াখেলা খেলেছে এই ফিলিস্তিনি সংগঠন।
গত মাসে এক নাটকীয় ফোনকল হামাসের মনোভাব পাল্টে দেয়। ওই কলেই ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে যুক্ত করেন কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে, দোহায় হামাস নেতাদের টার্গেট করে ইসরায়েলের বোমা হামলার ঘটনায় ক্ষমা চাওয়ার জন্য।
এই ঘটনাই হামাসের চোখে ট্রাম্পকে এমন এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরে, যিনি প্রয়োজনে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারেন এবং গাজা যুদ্ধের অবসানে সত্যিই আগ্রহী।
কাতারে ব্যর্থ বোমা হামলায় হামাসের প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়া অল্পের জন্য রক্ষা পান। এ ঘটনায় ট্রাম্পের তৎপরতা এবং কাতারকে দেওয়া আশ্বাসে হামাস মনে করে এই মানুষটা ইসরায়েলকেও চাপে রাখতে পারে।
এরপরই, গত বুধবার ট্রাম্প-মধ্যস্থতাধীন যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে হামাস। চুক্তি অনুযায়ী, তারা সব জিম্মি মুক্তি দেবে, এমনকি ইসরায়েলি সেনা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ছাড়াই।
দুই হামাস কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, এই সিদ্ধান্ত ঝুঁকিপূর্ণ বাজি, যা নির্ভর করছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার ওপর।
এই সিদ্ধান্ত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। জানুয়ারির আগের যুদ্ধবিরতিতেও ইসরায়েল একইভাবে চুক্তি ভেঙে অভিযান চালায়। তবুও, শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক আলোচনায় ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ জ্যারেড কুশনার ও স্টিভ উইটকফ-এর উপস্থিতি এবং কাতার, মিশর, তুরস্কের সক্রিয় ভূমিকা হামাসকে আশ্বস্ত করে।
এক হামাস প্রতিনিধি বলেন, ট্রাম্প আলোচনার সময় তিনবার ফোন করেন। তার আগ্রহ পুরো সভাকক্ষ জুড়েই অনুভূত হয়েছে।
হোয়াইট হাউজের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, দোহায় ইসরায়েলি হামলার টিভি ফুটেজ দেখে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হন এবং কাতারের আমিরকে আশ্বাস দেন, এ রকম হামলা আর হবে না।
এই প্রকাশ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হামাসের আস্থা বাড়িয়ে দেয় যে, ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।
ইসরায়েলি বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাথন রেইনহোল্ড বলেন, ট্রাম্পের কাতারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি হামাসকে বিশ্বাস করিয়েছে যে এবার যুদ্ধবিরতি বাস্তবেই স্থায়ী হতে পারে।
হামাস আরও খেয়াল করেছে, জুনে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির সময় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমাদের যুদ্ধবিমান ঘরে ফেরাও।
গাজায় এক হামাস কর্মকর্তা বলেন, যদিও নাটকীয়, কিন্তু সে যা বলে, তাই করে — এটি আমাদের জন্য বার্তা যে, ট্রাম্প চাইলে ইসরায়েলকে থামাতে পারে।
ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা ২৯ সেপ্টেম্বর নেতানিয়াহুর হোয়াইট হাউজ সফরে ঘোষণা করা হয়। চার দিন পর হামাস শর্তসাপেক্ষে এতে সম্মতি জানায়।
চুক্তিতে বলা হয়েছে হামাস সব জিম্মি মুক্তি দেবে, ইসরায়েল গাজা থেকে আংশিকভাবে সেনা সরাবে এবং যুদ্ধবিরতি বজায় থাকবে।
তবে ইসরায়েল এখনও অর্ধেক গাজায় অবস্থান রাখবে, আর হামাসের অস্ত্র ত্যাগের বিষয়টি ভবিষ্যতের আলোচনার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে।
এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, এই দ্বিধাবিভক্ত অবস্থা ভবিষ্যতের আলোচনাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা হিসেবেই কাজ করবে।
আলোচনায় যুক্ত মার্কিন ও ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানান, মধ্যস্থতাকারীরা হামাসকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, জিম্মি ধরে রাখা এখন তাদের জন্য বোঝা, চাপ নয়।
এক হামাস প্রতিনিধি বলেন, বিশ্ব এখন আমাদের জিম্মি রাখাকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখছে। তাদের ছাড়ার পর ইসরায়েল যুদ্ধ পুনরায় শুরু করলে তার কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকবে না।
চুক্তিতে কোনো লিখিত মার্কিন গ্যারান্টি নেই, কেবল মৌখিক আশ্বাস। তবুও হামাস মিশর, কাতার, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের কথায় ভরসা রেখেছে যে, ট্রাম্প ইসরায়েলকে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করতে দেবেন না।
এক হামাস কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দৃষ্টিতে এই চুক্তি যুদ্ধের ইতি।
তবে হামাস জানে, এই বাজি উল্টো ফলও দিতে পারে। জানুয়ারির যুদ্ধবিরতিতে ট্রাম্প নিজেই হুমকি দিয়েছিলেন, সব জিম্মি এখনই ছাড়ো, নাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে।ওই চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর আরও ১৬ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, গাজায় তীব্র দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
এবারের পরিবেশ কিছুটা ভিন্ন — উভয়পক্ষই গুরুত্ব সহকারে এসেছে এবং কাতার, মিশর, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ স্পষ্টভাবে কাজ করছে বলে জানান হামাসের এক প্রতিনিধি।
রোববার (১২ অক্টোবর) থেকে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু হওয়ার কথা। কায়রো সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির পক্ষ থেকে।
এক মার্কিন সূত্র জানায়, এটি ছিল একেবারে কৌশলগত পদক্ষেপ। ট্রাম্পের ‘বিজয় ভ্রমণ’ চুক্তির স্থায়িত্ব আরও নিশ্চিত করবে।
সূত্র: রয়টার্স
এমএসএম