লাইফস্টাইল

ভাইরাল ‘কেকপট্টি’ তুলে দেওয়া কি ভালো হলো, নাকি খারাপ

তিনদিন আগেও আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের সামনের সড়কটি ছিল কেকের রাজ্য। সন্ধ্যা নামলেই ভেসে আসত ভ্যানিলা, রসমালাই, বাটার স্কচ কিংবা চকলেট কেকের ঘ্রাণ। ছোট-বড় সবার উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠতো মহল্লা।

ইউটিউবার-কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড় থাকতো কেকের দোকানগুলোতে। আর বাকিরা যেন শুধু কেক খেতে যেতেন না, বরং যেতেন ভাইরালের অংশ হতে।

অথচ আজ ব্যস্ত সড়কটি শান্ত, স্বাভাবিক। আর আশপাশের মানুষ বলছেন ‘এখন অন্তত নিশ্বাস নেওয়া যায়।’

তিনদিন আগেও আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের সামনের সড়ক ছিল কেকের রাজ্য। ছবি/মামুনূর রহমান হৃদয়

সবকিছুর শুরু জাকির ও তার স্ত্রীর হাত ধরে। নির্বাচন ভবনের সামনে একটি ছোট টেবিলে কেক বিক্রি করতেন তারা। ঘরে বানানো কেক, হাসিমুখ আর দাম্পত্য বোঝাপড়ার দৃশ্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ইউটিউব, টিকটক, ফেসবুক সবখানে ঘুরতে থাকে ‘ভাইরাল জাকির’র ভিডিও। এরপর দেখা যায়, তাদের পথ অনুসরণ করে একে একে হাজির হন আরও অনেকে।

তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘সিমি আপা’। তার সৌন্দর্য, বাচনভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস সব মিলিয়ে তিনিও হয়ে ওঠেন আরেক ভাইরাল মুখ। কেউ হাজার টাকার কেক বিক্রি করছেন, কেউ আবার লাখ টাকাকে ছুঁতে চাইছেন। এমনকি দেখা যায় এক কিশোর ডিজে অঙ্গভঙ্গিতে কেক বিক্রি করে রাতারাতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। ফলাফল- আগারগাঁওকে জনগণ চিনতে শুরু করে ‘কেকপট্টি’ কিংবা ‘কেকেরগাঁও’ নামে।

দিন যত গড়িয়েছে, ততই বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত পুরো রাস্তা যেন মেলায় পরিণত হয়। কেউ কেক খাচ্ছে, কেউ সেলফি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে। কিন্তু এই উৎসবের পেছনে লুকিয়ে ছিল শহুরে বিশৃঙ্খলার চেহারা।

ফুটপাত দখল হয়ে যায়, রাস্তার অর্ধেকজুড়ে বসে যায় কেকের দোকান। গাড়ির হর্ন, মানুষের ঠেলাঠেলি, আর পার্কিংয়ের বিশৃঙ্খলায় যান চলাচল ব্যাহত হতে থাকে প্রতিদিন।

নির্বাচন ভবন, আইডিবি ভবন ও আশপাশের স্থাপনার সামনেই বসে এই ভাসমান কেক বাজার। অফিসফেরত লোকজন, দর্শনার্থী ও পথচারীরা ক্রমে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ সরাসরি ৯৯৯-এ ফোন করে অভিযোগ করেন।

জায়গা পেলে কেক বিক্রেতারা আবার কোনো নির্দিষ্ট মার্কেট বা ফুডকোর্টে ফিরে আসতে চান। ছবি/ মামুনূর রহমান হৃদয়

এর‌ই প্রেক্ষিতে ৯ অক্টোবর শুক্রবার থেকে শুরু হয় পুলিশের অভিযান। শেরেবাংলা নগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমাউল হক ওই সময় বলেছিলেন, ‘এখানে কেকপট্টি আছে কি না, তা আমরা জানি না। আমরা জানি নির্বাচন কমিশনসহ এ এলাকায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে। আর অফিসে যাওয়ার রাস্তায় এসব দোকানপাট অবৈধভাবে বসেছে। ফলে যাতায়াতে প্রচুর সমস্যা হয় এবং সবসময় রাস্তায় যানজট লেগে থাকে।’

এদিকে বিক্রেতাদের কেউ কেউ বলছেন, জায়গা পেলে তারা আবার কোনো নির্দিষ্ট মার্কেট বা ফুডকোর্টে ফিরে আসতে চান।

তবে আশপাশের অফিস, বাসা, দোকানের লোকজন ও পথচারীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় পথচারী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে সন্ধ্যা নামলেই ফুটপাতের দোকানের সামনে মানুষে মানুষে ঠাসা হয়ে যেত। পথচারী কিংবা রোগী আসতে পারত না, গাড়ি থামাতে পারত না। এখন অন্তত শান্তি আছে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কেকপট্টি’ এখনো আলোচনায়। একটি মহল বলছে, ‘এটা ছিল তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার দারুণ উদাহরণ।’ আবার কেউ বলছেন, ‘ভাইরাল হওয়ার নেশা শেষমেশ ফুটপাত দখল আর বিশৃঙ্খলায় গড়িয়েছে।'

মোহাইমিনুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেন, ‘শুধু কেকের দোকান কেন! আগারগাঁওয়ের ফুটপাতে তো আরও অন্যান্য দোকান‌ আছে। সেগুলোও সরানো হোক।’

স্থানীয় বাসিন্দা ইমন সরকার মন্তব্য করেন, ‘ভালো উদ্যোগটা শেষমেশ অব্যবস্থাপনায় শেষ হলো। যদি কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় অনুমতি দিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে হয়তো সবার জন্যই বিষয়টা ভালো হতো।’

আজ নির্বাচন ভবনের সামনে দাঁড়ালে আগের সেই কোলাহল নেই। বাতাসে নেই কেকের মিষ্টি ঘ্রাণ, নেই সেলফির ভিড়, নেই হর্নের শব্দ। রাস্তা এখন খোলা, পথচারী নির্বিঘ্নে চলছে। একসময় যেখানে ‘কেকপট্টি’ নিয়ে হাসি-তামাশা ছিল, সেখানে এখন একরাশ নিঃশব্দ স্বস্তি, স্বাভাবিক চলাচল।

এএমপি/জিকেএস