মতামত

যোগ্য শিক্ষক চাইলে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে

শিক্ষকের নিকট আমাদের প্রত্যাশা অনেক অনেক বেশি। তাই বিভিন্নমুখী গুণে গুণান্বিত হতে হয় একজন শিক্ষককে। যা সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয়।

আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষককে থাকতে হয় সমৃদ্ধ। জানতে হয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সুফল-কুফল এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীকে দিতে হয় সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষা লাভে শিক্ষককে সদা-সর্বদা থাকতে হয় সক্রিয়। হতে হয় বই ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ পাঠক এবং সেভাবেই গড়ে তুলতে হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক নিজে হতে হয় সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী। যিনি নিজে শিক্ষার্থী নন, তিনি অন্যের শিক্ষক হবেন কী করে?

শিক্ষাদান শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য। আর শিক্ষাগ্রহণ শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। শিক্ষাদানের পূর্বশর্তই শিক্ষা গ্রহণ। প্রতিনিয়ত শিক্ষাদান কার্যের পূর্বপ্রস্তুতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত শিক্ষা গ্রহণ। অবশ্যই থাকতে হবে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ। যে শিক্ষক ভাববেন, আমি কেবল পড়াব, পড়ব না; সে শিক্ষক কখনো ভালো শিক্ষক হবেন না। শিক্ষক নিজের মধ্যে শিক্ষার সঠিক চর্চা করেই সঠিক পরিচর্যা করবেন শিক্ষার্থীর। ভালো শিক্ষক নিজের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা করবেন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, আজীবন। নিরলসভাবে অর্জন ও বিতরণ করবেন নতুন নতুন জ্ঞান। শিক্ষার্থী ও সমাজের সব মানুষকে করবেন জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ। আলোকিত করবেন দেশ ও জাতি।

যেকোনো পরিস্থিতিতে তুলনামূলক কম যোগ্যরা শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়ে গেলে তারা তাদের শিক্ষকতা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য নাগরিক। বিপরীত ক্রমে অধিক যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা অধিক হলে কম যোগ্যদের আধিপত্য হ্রাস পায়। অধিক যোগ্যরা মূল্যায়িত হয়, উৎসাহিত হয়, উজ্জীবিত হয়, উত্তম পাঠদানের পরিবেশ তৈরি হয়, শিক্ষার্থীরা অধিক লাভবান হয়।

একজন ভালো শিক্ষক হবেন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তার থাকবে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মতো মন-মানসিকতা। ভোগের চেয়ে ত্যাগের ইচ্ছাই থাকবে বেশি। তিনি কী পেলেন, তার চেয়ে বেশি ভাববেন কী দিলেন এবং কী দিতে পারলেন না। ভোগের চেয়ে ত্যাগেই বেশি আনন্দিত হবেন তিনি। বস্তু প্রাপ্তির নয়, জ্ঞান প্রাপ্তি ও প্রদানের সংগ্রামে অবতীর্ণ থাকবেন শিক্ষক।

কেবল বস্তুগত প্রপ্তির আশায় যিনি শিক্ষক হবেন ও শিক্ষকতা করবেন তিনি কখনো প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠবেন না। কেননা, প্রকৃত শিক্ষাদানের অন্তর্নিহিত অনাবিল আনন্দ ও শিক্ষাদানের অফুরান পুণ্য থেকে তিনি বঞ্চিতই থেকে যাবেন। শিক্ষকতার প্রকৃত পরিতৃপ্তি লাভের অতল সাগরে কোনোদিন যাওয়া হবে না তার। শিক্ষার্থীর জন্য যিনি নিবেদিতপ্রাণ তিনিই পরম শ্রদ্ধেয়। তাকেই শ্রদ্ধাভরে আজীবন মনে রাখে শিক্ষার্থী।

একজন ভালো শিক্ষক আজীবন লালন করবেন জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। শিক্ষককে জ্ঞানার্জনে হতে হবে নিরলস। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হতে হবে নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অত্যন্ত ভালোভাবে জানা থাকতে হবে শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাদানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।

অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবেন শিক্ষক। তিনি হবেন সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও বাস্তববাদী। তার আয়ত্তে থাকবে শিক্ষাদানের মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আধুনিক কলাকৌশল। একজন ভালো শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর মন-মানসিকতা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, আগ্রহ-অনাগ্রহ বোঝার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। নিজের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সবদিক থেকে প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করবেন শিক্ষক। সেই মূল্যায়নের আলোকেই দেখাবেন শিক্ষার্থীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ।

দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে পরিপূর্ণ হবেন শিক্ষক। ভালোভাবে জানবেন দেশ-জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নিজের মধ্যে গভীরভাবে লালন ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনভাবে সঞ্চালন করবেন দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা। দেশপ্রেমে ও জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করবেন শিক্ষার্থীদের।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষকের থাকতে হবে প্রাকৃতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হবেন শিক্ষক। থাকতে হবে প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ঐকান্তিক ইচ্ছা। নিজে শিখবেন এবং নিজের শিক্ষার্থীদের শিখাবেন প্রকৃতির পাঠ। সেই সঙ্গে শিখিয়ে দেবেন প্রকৃতির পাঠ রপ্ত করার কৌশল। শিক্ষার্থী যেন প্রকৃতিকে বানাতে পারে তার জীবনের নিত্য শিক্ষক।

এমন শিক্ষক পাওয়ার জন্যই বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা এবং শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে অধিক যোগ্যদের। আরো উন্নত করতে হবে শিক্ষক বাছাই প্রক্রিয়া। মনে রাখতে হবে, যিনি ছাত্রকালেই মেধাবী ছিলেন না, মননশীল ছিলেন না, উদ্যমী ছিলেন না, ধৈর্যশীল ছিলেন না, পরিশ্রমী ছিলেন না, সুশৃংখল ছিলেন না, নম্রভদ্র ছিলেন না, নৈতিক ছিলেন না, পাঠে আগ্রহী ছিলেন না, সহশিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন না, ভালো ফলাফল ধারী ছিলেন না, এক কথায় সার্বিক বিবেচনায় উত্তম শিক্ষার্থী ছিলেন না; তিনি শিক্ষক পদে নিয়োজিত হলেও উত্তম শিক্ষক হয়ে উঠবার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে না। এর অগণিত প্রমাণ আমাদের আশেপাশেই বিদ্যমান।

যেকোনো পরিস্থিতিতে তুলনামূলক কম যোগ্যরা শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়ে গেলে তারা তাদের শিক্ষকতা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য নাগরিক। বিপরীত ক্রমে অধিক যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা অধিক হলে কম যোগ্যদের আধিপত্য হ্রাস পায়। অধিক যোগ্যরা মূল্যায়িত হয়, উৎসাহিত হয়, উজ্জীবিত হয়, উত্তম পাঠদানের পরিবেশ তৈরি হয়, শিক্ষার্থীরা অধিক লাভবান হয়।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস