ক্যাম্পাস

কৃষিখাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে শুধু একটি গবেষণার বিষয় নয়, বরং মানুষের জীবনে দৃশ্যমান বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর থেকে উপকূল, উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রতিটি অঞ্চলে এর প্রভাব দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড জিওগ্রাফি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইনজামুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ইরফান উল্লাহ।

জাগো নিউজ: জলবায়ুর পরিবর্তনে পরিবেশে যে প্রভাব পড়ছে তার ওপর আপনার বিভাগে কোনো গবেষণা চলছে কি-না?

ইনজামুল হক: জলবায়ু পরিবর্তন একটি বহুমাত্রিক ইস্যু। আমাদের বিভাগে জলবায়ুর পরিবর্তনে পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রভাব নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা হয়। যদিও বর্তমানে আমি নিজে সরাসরি কোনো প্রজেক্টে যুক্ত নই, তবে আমার তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা কাজ করছে। যেমন: আরবান ক্লাইমেট, লবণাক্ততা, জলবায়ুজনিত দুর্যোগ—এসব নিয়ে মাইক্রো (ক্ষুদ্র) লেভেলের গবেষণা হচ্ছে। এছাড়া বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী কৃষিতে জলবায়ুর প্রভাব, দুর্যোগ পরিবর্তন, ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছে।

জাগো নিউজ: উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে?

ইনজামুল হক: উপকূলীয় অঞ্চলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি। যেমন: কুয়াকাটা বা পটুয়াখালী এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত, জোয়ার-ভাটা দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। পর্যটন স্পটগুলোর পাশেও এখনো বন্যার পানি প্রবেশ করছে। সম্প্রতি আমরা কুয়াকাটায় একটি ফিল্ড স্টাডি করেছি। সেখানে দেখা গেছে, যেসব জায়গায় দুর্যোগের আশঙ্কা কম ছিল, সেখানেও এখন জলাবদ্ধতা ও বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে চাষাবাদ, বসতবাড়ি ও নিরাপদ পানি ব্যবস্থা হুমকির মুখে।

জাগো নিউজ: শহরাঞ্চলেও কি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তীব্র হচ্ছে?

ইনজামুল হক: অবশ্যই। শহরে আমরা ‌‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ প্রভাব লক্ষ্য করছি। শহরে গাছপালা, খোলা মাঠ বা বড় পার্কের অভাবে তাপমাত্রা আশপাশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। এতে করে বাড়ছে হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা এমনকী স্ট্রোকের ঝুঁকি পর্যন্ত। আমরা দেখছি, অনেক বয়স্ক মানুষ অল্প গরমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, যা শহরের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

জাগো নিউজ: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিখাতে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?

ইনজামুল হক: কৃষিখাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যেমন: লবণাক্ততা বৃদ্ধি, খরা, অপরিকল্পিত বৃষ্টিপাতের কারণে ধান ও সবজি চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে চিংড়ি চাষে ঝুঁকছেন, যদিও এতে দীর্ঘমেয়াদে ভূমির উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে। অনিশ্চিত আবহাওয়ার কারণে ফসলের সময়মতো ফলন হচ্ছে না, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এছাড়া কৃষিখাত খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য কৃষিখাতে অনেক উদ্যোগ লক্ষণীয়। তবে বেশিরভাগ উদ্যোগই আমাদের খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করছে ঠিকই, কিন্তু ক্রমাগত স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

জাগো নিউজ: জনস্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা?

ইনজামুল হক: জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম উপেক্ষিত প্রভাব পড়েছে জনস্বাস্থ্যে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও দূষণের কারণে শহরে শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ এবং হৃদ্‌রোগ বেড়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির সংকট ও জলাবদ্ধতা পানিবাহিত রোগের জন্ম দিচ্ছে। আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে আছি, যেখানে হেলথ-সেক্টরকে সরাসরি ক্লাইমেট অ্যাকশনের অংশ হিসেবেই ভাবতে হবে।

জাগো নিউজ: এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা কি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারবে?

ইনজামুল হক: অবশ্যই পারবে। এটি আমাদের একাডেমিক এবং সামাজিক দায়িত্ব। শিক্ষার্থীরা শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না; তাদেরকে মাঠ পর্যায়ে, গবেষণায়, সচেতনতায় যুক্ত হতে হবে। আমাদের বিভাগে আমরা বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিরোধ, সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে কাজ করি এবং শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করি। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষার্থীরাই জলবায়ু আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে।

জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা আপনি আশা করেন?

ইনজামুল হক: আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরাসরি আর্থিক সহায়তা তেমন পাই না। গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন, যা এখনো ঘাটতির মধ্যেই পড়ে। প্রশাসন আমাদের উদ্যোগকে মৌখিকভাবে সমর্থন করে কিন্তু বাজেটবান্ধব সহায়তা এখনো পাইনি। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের কাছে আবেদন করলে পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষণায় আলাদা বাজেট বরাদ্দ হতে পারে, যা ভবিষ্যতে কার্যকর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

জাগো নিউজ: জলবায়ু পরিবর্তনের শিক্ষা কীভাবে জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়?

ইনজামুল হক: প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ক্লাইমেট চেঞ্জকে পাঠ্যক্রমে আরও বাস্তবধর্মী ও ব্যবহারিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেমন প্রকল্পভিত্তিক কাজ, কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস, স্থানীয় জলবায়ুবিষয়ক সমস্যা বিশ্লেষণ ইত্যাদি। তরুণ প্রজন্মকে শুধু বইয়ের পাতায় রেখে নয়, বাস্তবতার মুখোমুখি করে তুলতে হবে।

জাগো নিউজ: আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ কীভাবে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে পারে?

ইনজামুল হক: আমাদের ক্লাইমেট পলিসিতে গবেষণানির্ভরতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরিকল্পনা করতে হবে। একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি খাত এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। যেসব কাজ এখনো কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, সেগুলো মাঠে কার্যকর করতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়, বরং বর্তমানের কঠিন বাস্তবতা। এ সংকট মোকাবেলায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসন ও সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

এসআর/এএসএম