রাজশাহীতে দিন দিন বাড়ছে তাপমাত্রা। গত ৫২ বছরের রেকর্ডে এ জেলার তাপমাত্রায় নতুন রেকর্ড করে গত বছর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও সবুজ কমে যাওয়া এবং বহুতল ভবন বাড়ার কারণে গরম বাড়ছে। ফলে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাই গরম থেকে বাঁচতে চাই দ্রুত উদ্যোগ।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি শহরের পরিকল্পিত নগরায়ণ, তাপমাত্রার আরামদায়ক অবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি বাসযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, এই তিন দশকে নগরীর সবুজ এলাকা কমেছে ২৬ শতাংশ এবং জলাধার কমেছে ৩ শতাংশ। বিপরীতে নির্মিত অবকাঠামো বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। এ সময় নির্মিত অবকাঠামোর পরিমাণ ৯.৭৩ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ২২.৯৯ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে সবুজ এলাকা কমেছে ১২.৪৮ বর্গ কিলোমিটার এবং জলাশয় কমেছে ১.৪৪ বর্গ কিলোমিটার।
এদিকে শহরের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১০ লাখে পৌঁছেছে, যা বছরে ২.৮৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে জলবায়ু-সংবেদনশীল পরিকল্পনার কোনো মিল নেই।
রাজশাহী আবহাওয়া দফতরের রেকর্ড অনুযায়ী, রাজশাহীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর আর কখনো এত তাপমাত্রা ওঠেনি। তবে ২০২৪ সালে ওই তাপমাত্রার কাছাকাছি গিয়ে রেকর্ড করে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ২০০৫ সালে ৪২.৮ ডিগ্রি, ২০০৬ সালে ৩৯ .০৬ ডিগ্রি, ২০০৭ সালে ৪২.০২ ডিগ্রি, ২০০৮ সালে ৪০ ডিগ্রি, ২০০৯ সালে ৪১.০৮ ডিগ্রি, ২০১০ সালে ৪২.৫ ডিগ্রি, ২০১১ সালে ৩৮ ডিগ্রি, ২০১২ সালে ৪২ ডিগ্রি, ২০১৩ সালে ৪১.২ ডিগ্রি, ২০১৪ সালে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি, ২০১৫ সালে ৩৮.৫ ডিগ্রি, ২০১৬ সালে ৪১.২ ডিগ্রি, ২০১৭ সালে ৩৮.৪ ডিগ্রি, ২০১৮ সালে ৪০ ডিগ্রি, ২০১৯ সালে ৪০ ডিগ্রি, ২০২০ সালে ৩৯.২ ডিগ্রি, ২০২১ সালে ৪০.৩ ডিগ্রি, ২০২২ সালে ৪১.২ ডিগ্রি, ২০২৩ সালে ৪২.৬ ডিগ্রি, ২০২৪ সালে ৪৩ ডিগ্রি ও সর্বশেষ ২০২৫ সালে সর্বোচ্চ ৪০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- ‘হিট আইল্যান্ড’ হয়ে উঠছে সিলেটমাইকিংয়ে সীমাবদ্ধ প্রশাসন, পাহাড়ধসে বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলপানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম বলেন, ভৌগলিক কারণে রাজশাহী বিভাগের তাপমাত্রা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশি হয়। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশের দিল্লিতে বাংলাদেশের থেকে কয়েক ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা হয়। দিল্লির এই তাপমাত্রা বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে প্রভাবিত হয়, সেই প্রভাব রাজশাহীতেও পড়ে।
ওই গবেষণার প্রধান লেখক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. রেজাউর রহমান বর্তমানে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ফুলব্রাইট ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘সবুজ ও জলাধার কমে যাওয়ায় শহর তার উষ্ণতা মোকাবিলার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হারিয়েছে। শহরের বাসিন্দারাও এই পরিবর্তন অনুভব করছেন। এক সময় আমরা কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল ও ঠান্ডা বাতাস দিয়ে শীতকে স্বাগত জানাতাম। এখন অক্টোবরেও গরম পড়ে।’
অধ্যাপক রেজাউর রহমান আরও বলেন, ‘রাজশাহী কৃষি ও খোলা ভূমি থেকে একটি ঘন শহুরে কাঠামোতে রূপান্তরিত হওয়ায় শীতকালেও শহরটি উল্লেখযোগ্যভাবে উষ্ণ হয়ে উঠেছে। যদি এটি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে এটি শহুরে অস্বস্তি, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়াবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড. চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, রাজশাহীতে বহুতল ভবন বাড়ছে। তবে সেই অনুপাতে জলভূমি কমে যাচ্ছে। পাশের পদ্মাও শুকিয়ে যাচ্ছে। বালুময় পদ্মাতেও গরম বাড়ছে। ফলে এখানে একটি হিট চেম্বার তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি বৃষ্টি ও নদীর পানির ব্যবহার কমেছে। ফলে রাজশাহীতে গরম বাড়ছে।
তিনি বলেন, যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে না। বৃষ্টির পানি আমরা সংরক্ষণ করতে পারছি না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাচ্ছে, গরম বাড়ছে। এটি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের নদী ও খালগুলো পুনঃখনন এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা জরুরি।
এফএ/এএসএম